ধর্ষণই নেশা সিলেটের আজাদের : যে কারণে ধর্ষিতার ভয়
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ জুলাই ২০২০, ১২:১২ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরু:
ধর্ষণই নেশা সিলেটের কানাইঘাটের আজাদের। প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। এ কারণে গ্রামের মানুষ সমীহ করে তাকে। কিন্তু এই সুযোগে সে গ্রামের নিরীহ পরিবারের সুন্দরী বধূ কিংবা তরুণীদের ধর্ষণ করে চলছিলো। সর্বশেষ গত বুধবার মধ্যরাতে ঘটিয়েছে আলোচিত একটি ধর্ষণের ঘটনা। এই ঘটনার পর থেকে কানাইঘাটে বিরাজ করছে ক্ষোভ। প্রশাসন সক্রিয় হয়েছে। ধর্ষণের পর পালিয়ে যাওয়া আজাদকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
র্যাব গ্রেপ্তার করেছে তার সহযোগী মখনকে। পুলিশ ও র্যাব সক্রিয় হয়ে আসামি ধরলেও নির্যাতিত ওই গৃহবধূর পরিবার মামলায় যেতে ভয়ে ছিল। ঘটনার ৫ দিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দেয়া হয়নি। অবশেষে পুলিশই উদ্যোগী হয়ে গতকাল ওসমানীর ওসিসিতে থাকা ধর্ষিতা মহিলা ও স্বামীকে থানায় নিয়ে মামলা দায়ের করেছে। আলোচিত এ ধর্ষণের ঘটনায় সিলেটেও তোলপাড় চলছে। সংক্ষুব্ধরা ইতিমধ্যে সিলেটে মানববন্ধন করে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে।
কানাইঘাটের বাণীগ্রাম ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগ্রামের বাসিন্দা ওই গৃহবধূ। স্বামী এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। স্থানীয় গাছবাড়ি বাজার এলাকায় তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গত বুধবার সিলেটে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় অবিরাম বর্ষণ। এ কারণে স্বামী নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই আটকা পড়েন। বাড়ি ফিরতে পারছিলেন না তিনি। এদিকে স্বামী না ফেরার কারণে ওই মহিলা কোলের সন্তানকে নিয়ে নিজ ঘরেই ঘুমিয়ে পড়েন। মাটির বেড়ার ঘর। ধর্ষক আজাদ ও তার সহযোগীদের চোখ অনেক আগেই ছিল ওই গৃহবধূর উপর। সুযোগ বুঝে ঝড়-বাদলের দিন মধ্যরাতে তারা ঘরের দরোজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর তারা ওই মহিলার ওপর জোরপূর্বক পাশবিক নির্যাতন চালায়। তাদের ক্রমাগত নির্যাতনে এক সময় অজ্ঞান হয়ে পড়েন ওই গৃহবধূ। ধর্ষকরা চলে যাওয়ার পর আশেপাশের লোকজন এসে দেখেন ওই মহিলা ঘরের ভেতরে রক্তাক্ত অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।
খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক গাছবাড়ি বাজার থেকে ছুটে আসেন স্বামীও। স্ত্রীর এই অবস্থা দেখে তিনি নিজেও অবাক হয়ে যান। রাতেই তাকে নিয়ে আসেন সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে। স্বামী জানান, ওসিসিতে নিয়ে আসার পর তার চিকিৎসা শুরু হয়। সকালে তার স্ত্রীর জ্ঞান ফিরলে তিনি রাতে তার ওপর চলা নির্মমতার কথা জানান। এদিকে ঘটনার পর থেকে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলে। ধর্ষক আজাদের পক্ষ থেকে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়। এতে করে ভয়ে পুলিশের কাছে যাননি বলে দাবি করেন ধর্ষিতা মহিলার স্বামী। পুলিশ ঘটনাটি জানলেও নির্যাতিত মহিলার পরিবারের পক্ষ থেকে ঘটনার ব্যাপারে কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। ফলে পুলিশ আইনিভাবে ব্যবস্থা নিতে পারছিলো না। এই অবস্থায় বিষয়টি জানাজানি হলে কানাইঘাটে তোলপাড় শুরু হয়। এমন ঘটনায় ধিক্কার শুরু হয় সর্বত্রই। ঘটনাটি পৌঁছে সিলেটে অবস্থানরত কানাইঘাটের বাসিন্দাদের কাছে। তারাও ঘটনার প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। ধর্ষণের বিষয়টি জানিয়ে তারা ঘটনার বিচার দাবি করে সিলেটে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি দেন।
কানাইঘাট স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের উদ্যোগে শনিবার বিকালে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। কানাইঘাট স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি আসিফ আজহারের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল ইসলাম চৌধুরীর পরিচালনায় নেতৃবৃন্দ সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে সকল অপকর্মের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি গ্রামগঞ্জে তরুণ ও শিক্ষিত সমাজকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এরপর সিলেটের জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়। এসময় অসহায় ভিকটিম পরিবারকে আইনি সহায়তা দিতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা। তারা মূল ঘটনাকারী আজাদকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান। মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন- সিলেট জজ কোর্টের এপিপি এডভোকেট মামুন রশিদ, জৈন্তাপুর প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ফয়েজ আহমদ, সিলেট অনলাইন প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাওহিদুল ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন কানাইঘাট স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও বাংলাদেশ পোস্টের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মাহবুব এ রহমান, নোমান আহমদ সোহেল ও নূর আহমদ প্রমুখ।
স্মারকলিপি পাওয়ার পর ঊর্ধ্বতনরা ঘটনাটি অনুধাবন করেন। এরপর ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে কানাইঘাট থানা পুলিশ ধর্ষিতার মুখ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রোববার ভোররাতে গ্রেপ্তার করেছে ঘটনার নেতৃত্ব দেওয়া আজাদুর রহমান আজাদকে। তার বাড়িও একই গ্রামে। বয়স খুব বেশি নয়। ২৫ কিংবা ২৬ বছর। এরপরও সে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে চলছিলো। কানাইঘাট থানার এসআই স্বপন চন্দ্র সরকার আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কানাইঘাট থানার এসআই স্বপন চন্দ্র সরকার জানিয়েছেন, রোববার ভোররাতে আজাদকে গোয়াইনঘাট উপজেলা থেকে আটক করা হয়। এদিকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত মখন নামের আরো একজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৯। এদিকে- আসামিদের গ্রেপ্তার করলেও ভয়ে মামলায় যাচ্ছিলো না ধর্ষিতার পরিবার। এ কারণে সকালে কানাইঘাট থানা পুলিশের ফেসবুক আইডিতে থানার অফিসার ইনচার্জ একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন- ‘ব্রাহ্মণগ্রাম নামক গ্রামে নারী নির্যাতনের ঘটনা সংক্রান্তে কানাইঘাট থানা পুলিশ মামলা দায়েরের জন্য বাদীনিকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। বাদী-বাদীনিকে মোবাইল ফোনে কল করে একাধিক বার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে বাদী থানায় আসছে না। বর্তমানে বাদী-বাদীনির মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তার বাড়িতে খোঁজ করে তাকে পাওয়া যায়নি। যারা এই মামলা নিয়ে আগ্রহী তাদেরকে অনুরোধ করছি- তারা যেন বাদী-বাদিনীকে থানায় এনে মামলা দায়েরের ব্যবস্থা করেন। অথবা বাদী-বাদীনির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে পুলিশী সেবা প্রদানের নিমিত্তে জরুরী ভিত্তিতে কানাইঘাট থানার ডিউটি অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়।’
এদিকে- বিকেলে কানাইঘাট থানার ওসি মো. শামসুদ্দোহা জানিয়েছেন- ওসমানী হাসপাতালের ওসিসিতে পুলিশ পাঠিয়ে তিনি বাদিকে পেয়েছেন। এজাহার তৈরি হচ্ছে। থানায় গেলে মামলা দায়ের করা হবে। এ ঘটনার কোনো আসামিকে ছাড় দেওয়া হবে না জানান তিনি। দ্রুততম সময়ে চার্জশিট দাখিল করে আসামিদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলে জানান তিনি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- আজাদুর রহমান আজাদ প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান হওয়ায় এলাকায় একের পর এক জঘন্য অপরাধের জন্ম দিয়ে চলছে সে। ২০১৫ সালের শুরুতেই আজাদুর রহমান দিন দুপুরে ভ্রাক্ষণগ্রামের হাওড়ের রাস্তায় ধারালো ছুরির ভয় দেখিয়ে স্থানীয় আল-হেরা মাদ্রাসার এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। সেই দিন বিষয়টি অনেকেই দেখলেও আজাদের প্রভাবশালী পরিবারের ভয়ে কেউ মুখ খুলেনি। পরে বিষয়টি এলাকায় রটে গেলে স্থানীয় ভাবে তা মীমাংসা করার চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনার কয়েক মাস যেতে না যেতেই চলে আসে পবিত্র রমজান মাস। সেই মাসে অনুরূপ ভাবে ধারালো অস্ত্র গলায় ঠেকিয়ে আজাদুর রহমান এক মেয়েকে রাতের আধারে ধর্ষণ করে। পরে মেয়েটি ও তার পরিবারকে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়া হয়। একবার পাশের গ্রামের এক মহিলা মাড়াই মেশিনে ধনিয়া ও মরিচ ভাঙাতে এসেছিলেন। সেই মহিলা তার বাড়িতে ফেরার সময় ওত পেতে থাকা একা রাস্তার মধ্যে লম্পট আজাদ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেইদিন ওই মহিলা তার সম্ভ্রম রক্ষার জন্য আজাদের হাতে কামড় দিয়ে তার নিজের ইজ্জত অবশ্যই রক্ষা করেন। এ ব্যাপারে ধর্ষক আজাদের পিতা নুর উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন- ‘ঘটনাটি আমি শুনেছি। স্থানীয় বিচারের মাধ্যমে তা সমাধানের চেষ্টা করবো। এবং ন্যায়বিচার হবে।’