কানাইঘাটী ফতোয়া বনাম গোয়াইনঘাটের পিছিয়ে পড়া
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:৩১:০৬,অপরাহ্ন ০৩ জুলাই ২০২০
(১)
আমার লেখাটা কেউ অন্যভাবে নিবেন না।কেউ কষ্ট পেলে প্রথমেই দু:খ প্রকাশ করছি।
ছোট বেলা থেকেই লজিং থেকে পড়াশোনা করতাম। আমার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের প্রথম ব্যাচের প্রথম ছাত্র আমি, এবং এলাকার মধ্যে প্রথম এম এ পাশ ছেলে। এক সাথে ৭-৮ জন প্রাইমারী শেষ করে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হব, ঠিক ঐ মহুর্তে সবাইকে বলা হল, স্কুলের পড়ার দরকার নেই। স্কুলের পড়া হল দুনিয়াবী পড়া।আর মাদ্রাসার পড়া হল আখেরাতের পড়া।দুনিয়া আখেরাতের তুলনায় তুচ্ছ।তাই স্কুল ছেড়ে মাদ্রাসায় আসো।আমি বাদে বাকি সবাই মাদ্রাসায় চলে গেল। আর আমি রয়ে গেলাম দুনিয়ার পড়ার জন্য।
দুনিয়াবী পড়ে, তেমন কিছু করতে পারিনী, তবে এলাকার উন্নয়নে বিশেষ করে, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ইত্যাদির ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান, এম পি ,মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে যোগাযোগ করে কিছুটা উন্নয়নমুলক কাজ করিয়েছি। ধাপে ধাপে আরো হবে ইনশাহ আল্লাহ।
(২)
লজিং থেকে বাড়িতে গেলে, ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে মসজিদে যেতাম, আমাকে দেখে মসজিদের ইমাম ওয়াজ শুরু করতেন, স্কুল কলেজের পড়া, এসব দুনিয়াবী পড়া, এসব আখেরাতে কোন কাজে আসবে না,ইত্যাদি ইত্যাদি। বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করতেন, যাতে আমি অনুভব করি, আমি স্কুল -কলেজে লেখা পড়া করে ধবংসের দ্ধার প্রান্তে চলে যাচ্ছি।আর মাদ্রাসায় লেখা পড়া করে, বাকিরা সরাসরি জান্নাতে চলে যাচ্ছে।
গ্রামে গঞ্জে, পাড়ায় মহল্লায় ওয়াজ মাহফিল হত।
বিভিন্ন ওয়াজের প্রধান মেহমান থাকতেন কানাইঘাটের।
সরাসরি কানাইঘাট বাড়ী অথবা, কানাইঘাট মাদ্রাসা থেকে পাশ করা আলেম মাহফিলে ওয়াজ করতেন।
বিভিন্ন ওয়াজে হুজুররা বলতেন, স্কুল কলেজের পড়া হল দুনিয়াবী পড়া,ইংরেজি শিক্ষা হারাম ,নারী শিক্ষা হারাম, নারীদের ঘরের বাইরে বের করা হারাম, নারীদের চাকুরি করানো হারাম।এই হারাম হারাম ফতোয়া দিয়ে সাধারণ মানুষ কে স্কুল -কলেজের শিক্ষারপ্রতি এক ধরণের অনাগ্রহ তৈরী করতেন। গোয়াইনঘাটের বেশীর ভাগ মানুষ স্কুল -কলেজ তৈরি করতে এক সময় খুব অনিহা প্রকাশ করত।বিভিন্ন এলাকায় বাধা ও দিত।পক্ষান্তরে গ্রামে গ্রামে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। যার ফলে গোয়াইনঘাট এ এখন পর্যন্ত যতটা কওমি মাদ্রাসা আছে ততটা প্রাইমারী স্কুল নেই। হাইস্কুল, কলেজ ত বহুত দুরের কথা।যার কারণে উচ্চ শিক্ষা, সরকারি উচ্চ চাকুরির ক্ষেত্রে সাবেক জৈন্তিয়ার মধ্যে গোয়াইনঘাট অনেক পিছিয়ে।মানুষ স্কুল কলেজে পড়ানোর জন্য কোন আগ্রহ দেখাত না।যে কয়েকজন পড়াশোনা করে বেরিয়ে এসেছেন, সরকারি চাকুরি করছেন, তা একমাত্র পারিবারিক আধুনিক শিক্ষার কারণে।হুজুররা অগ্রহায়ণ ও বৈশাখে গ্রামে গ্রামে হাটতেন, ধান, চাল, চাদা তুলতেন, ওয়াজ করতেন এবং মানুষ কে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন, মাদ্রাসায় পড়ানোর গুরুত্ব বুঝাতেন ।এত কিছু করার পরও গোয়াইনঘাট এ এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মানের কোন আলেমের জন্ম হয় নি।
(৩) আজ কানাইঘাটের জয় জয়কার। এক সাথে দুই বোন BCS এডমিন ক্যাডার। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ঐ হুজুররা কি আজ ফতোয়া দিতে পারবেন, যাদের এডমিন ক্যাডারে চাকুরি হয়েছে, তাদের চাকুরী করা হারাম। এটা কখনোই পারবেন না।তখনকার সময়ে,গোয়াইনঘাটে এসে স্কুল-কলেজের পড়ার প্রতি অনাগ্রহ তৈরি এবং নারী শিক্ষা হারাম, নারী চাকুরি হারাম বলে ফতোয়া দিলেও কানাইঘাটে এসব ফতোয়া দিতেন না।বরং উল্টো, তাদের ছেলে মেয়ে আত্নীয় স্বজন,পাড়া প্রতিবেশীকে স্কুল, কলেজে পড়াতেন, ডাক্তার, এডভোকেট, ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছেন। যার বাস্তব ফলাফল হল, যেখানে কানাইঘাটে এক সাথে ২ বোনের বিসিএস এডমিন ক্যাডার হয়,এরা ছাড়া উচ্চ পর্যায়ে অনেক লোক রয়েছেন,বিভিন্নভাবে এখন কানাইঘাট সেরাদের সেরা। সেখানে গোয়াইনঘাট আজ পর্যন্ত একজন BCS এডমিন এর জন্ম দিতে পারে নি। আমি কানাইঘাটের বিরোধী নয়। আবার শ্রদ্ধেয় আলেম সমাজের বিরোধী নয়, তবে তএই ধরণের ফতোয়াবাজী করে, মানুষের ব্রেইন ওয়াশ করে আমাদের এলাকাকে, যে কতটা পিছিয়ে ফেলে দিয়েছেন, তা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।গোয়াইনঘাট এ মাদ্রাসা বেশী, আলেম উলামা বেশী, আবার অপরাধ প্রবণতা বেশী।গরু চুরি, নৌকা চুরি,ডাকাতি, খুন, গ্রামে গ্রামে মারামারি ইত্যাদির জন্য অতীতকাল থেকে আমরা বেশ পরিচিতি লাভ করেছি।মারামারি করে নিজের গ্রামে, কোর্টে এসে কানাইঘাটী উকিলকে টাকার বস্তা দিয়ে যায়। এই ভাবে চলছে দীর্ঘ কাল ধরে।
(৪)
সময় এসেছে জেগে উঠার। অনেক পিছিয়ে পড়েছি, আর নয়। তরুণ সমাজকে বাস্তবতা বুঝতে হবে।যে কোন মাধ্যমে শিক্ষা অর্জন করেন না কেন।কওমি, আলীয়া,স্কুল, কলেজ তাতে অসুবিধা নেই।তবে বাস্তব জিনিস বুঝতে হবে।ওয়াজ করলে বাস্তবভিত্তিক করতে হবে। মানুষ কে ভাল কাজের দিকে প্রেরণা দিতে হবে।স্বীদ্ধান্ত নিতে হবে ,আগামী ১০ বছরে পিছিয়ে পড়া গোয়াইনঘাট কে সেরা দের সেরা স্থানে কিভাবে পৌছানো যায়।দল, মত নির্বিশেষে আমাদের বর্তমান অবস্থান মুল্যায়ণ করতে হবে,কত টুকু পিছিয়ে পড়েছি, কেন পড়েছি এবং কি কি স্থানে পিছিয়ে পড়েছি,তা খুজে বের করতে হবে। এ থেকে উত্তরণের পথ খুজে বের করতে হবে। মনে রাখতে হবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আগামী ১০ বছরে যদি এগিয়ে না আসি, তাহলে পরবর্তী ১০০ পিছিয়ে যাব। নীতি নির্ধারকদের এখনোই ভাবতে হবে।