শপিংমলের শহরে মহা আতঙ্ক: সিলেট কি প্রস্তুত? নাকি ভাগ্যের উপরেই সব!
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ মে ২০২০, ৪:৪০ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ :
আশার বিষয় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার কম। কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা ভয়ানকভাবে বাড়ছে। মনে হচ্ছে চার ডিজিটে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রশ্ন উঠছে দোকানপাট খুললে এ চিত্র পৌঁছবে কোথায়। মঙ্গলবার সরকার বলেছে, সারাদেশে আক্রান্ত ৭৮৬। এটা সর্বোচ্চ রেকর্ড। এটা কদিনেই হাজারের ঘরে যাবে বলে আশঙ্কা।
সিলেটের জন্য এই মুহূর্তে যেটা সবথেকে আশঙ্কার সেটা হলো সুস্থ হওয়া মানুষের মধ্যে সিলেট সব থেকে তলানিতে। সরকারি বুলেটিন (৪ মে পর্যন্ত) বিশ্লেষণে দেখা যায়,সারাদেশে সুস্থ হওয়া ১২০৯ জন রোগীর মধ্যে সিলেট সব থেকে তলানিতে। মাত্র ২ জন সুস্থ হয়েছেন। আবার টেস্টের মধ্যেও দুই কোটি মানুষের অঞ্চলের টেস্ট করানোর প্রধান ভরসাস্থল সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ। এখানে এ পর্যন্ত ২৭১০জনের টেস্ট হয়েছে। অথচ ময়মনসিংহ ও রংপুর মেডিকেল কলেজে যথাক্রমে ৪৬১২ এবং ৩৬৩৯টি টেস্ট হয়েছে। দুটি পরিসংখ্যান অন্তত এটা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ওই দুটি অঞ্চলের থেকে টেস্টে পিছিয়ে আছে এই ‘লন্ডন’ জনপদ।
করোনা হালফিলের সরকারি ওয়েবপেইজে যান। দেখবেন তিনটি রঙ আছে। সবুজ, কমলা ও লাল। তিনটি বিভাগ সম্পূর্ণ লকডাউন। এরমধ্যে সিলেট অন্যতম। তবে সিলেটের অবস্থা অন্য সবার থেকে শোচনীয়। কারণ সিলেটের চারটি জেলার ৪০টি উপজেলার মধ্যে ৩৮টি উপজেলাই সরকারি নথিপত্রে ‘’সম্পূর্ণ লকডাউন’’। তাই পুরো রেডজোনের একটি অঞ্চলে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টি পর্যন্ত দোকানপাট খোলার সিদ্ধান্তের প্রভাব কি হতে পারে, সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন।
সিলেট হলো শপিংমলের শহর। সীমান্তের ওপারে গৌহাটি বা শিলচরকেও বলা যাবে শপিংমলের শহর। ভারতও লকডাউন শিথিল করেছে। বাংলাদেশও করছে। প্রায় একইসময়ে। তবে করোনার ডু’স এন্ড ডোন্ট’স বা করোনায় কি করো আর কি করোনা, সেটা আসামের নির্দেশনার সঙ্গে তুলনা করলে গলদটা বুঝতে সহায়ক হতে পারে। ১০ টা থেকে ৪টা খুলতে যাচ্ছে সিলেট। অবশ্য লকডাউন সিলেটে বিলম্বে এসেছে। কিন্তু কখনও তা নখদন্তওয়ালা লকডাউন হয়নি। গত কয়েকদিনে দৃশ্যপট আরো বদলাচ্ছে। টহল দেওয়া গাড়িগুলোর আনাগোনা মিইয়ে এসেছে। অবশ্য সবসময় কোনো না কোনোভাবে খোলা বা ঢিলেঢালা থেকেছে। সেটা নিয়ে জেলা প্রশাসন উদাসীন থেকেছে। উদাসীন থেকেছে নগর প্রশাসন। অবশ্য রিলিফ নিয়ে দায়িত্বশীলরা ভয়ংকর মনোযোগী ছিলেন। তাই লকডাউনের সুফল নগরবাসী পায়নি। সিলেটে যে হারে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, সেই অনুপাত দেখে মানুষ উদ্বিগ্ন। রোববার আসাম সরকারের তরফ থেকে রাজ্যের পক্ষ থেকে লকডাউন নিয়ে পূর্ণ নিয়ম-নীতি পেশ করা হয় । কি করতে হবে । আর কি করতে হবে না । সিলেটের নগর প্রশাসন বা জেলা প্রশাসন এমনটা দেবে কি? সবসময় সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে কেন। সরকারি ঘোষণায়ও বলা হয়েছে, বিষয়টি স্থানীয়ভাবে পুনর্নির্ধারণ করা যাবে। ১০টা-৪টা মানতেই হবে, তা নয়।
আসামে তালিকা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তবে এই নিয়ম-নীতিগুলো সম্পূর্ণভাবে শুধুমাত্র গ্রীনজোন এলাকার জন্যই। সুতরাং ওপারে দোকান খুলে দেয়া হয়েছে । এপারেও দোকান খোলা হয়েছে । এই দুই কথা বোঝার মধ্যে তফাৎ থাকবে। মৃত্যু ও আক্রান্তের উভয় দিক বিবেচনায় আসাম অনেক কম। সিলেট অনেক বেশি। আসামে শর্তের ছড়াছড়ি। সিলেটে শুধু দোকানদারকে খেয়াল রাখতে হবে সময়ের দিকে । কিন্তু কারা মাস্ক পরে এলো কিংবা এলো না, তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখল কিনা, সেজন্য মৌখিক বারণ থাকলেও তাদের জন্য কোন আইনগত শাস্তি পাওয়ার কোনো হুমকি নেই । কিন্তু আসামে সেটা আছে । সরকার কড়াকড়িভাবে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। সিলেটে এটা বাধ্যতামূলক নয়।
ওপারে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত গোটা রাজ্য জুড়ে কারফিউ জারি থাকবে কিন্তু এপারে সেটা থাকবে না। থাকলেও আছে মৌখিক। মানলে মানুন, না মানলেও যেনো আপত্তি নেই। ৩ মে থেকে আসামের প্রতিটি হাসপাতলে করোনা সংক্রান্ত সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। সিলেটে তা করা হয়নি।
গ্রাম–শহর সব জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে পানের দোকান, বিড়ির দোকান চায়ের দোকান বা ছোট মুদি দোকান থাকে। এ ধরনের দোকান সাধারণত বেশ কিছুটা খালি জায়গা রেখে থাকে। সুতরাং এগুলোর ক্ষেত্রে কোনো বাধা-নিষেধ নেই । কিন্তু শপিং মল ওপারে নিষিদ্ধ। এপারে বিশেষভাবে খোলা। এ বিষয়ে কোনো আলাদা নির্দেশনা দেয়া হবে কিনা, বড় দোকানগুলোর মালিকদের এনিয়ে বিকার আছে, তা বোঝা যায় না। এক্ষেত্রে সিলেটে কি ধরনের কড়াকড়ি, আর এসবের ক্ষেত্রে আলাদা কোন নিয়মের কথা কোন কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই উল্লেখ করেননি।
মিষ্টির দোকান, রেস্টুরেন্ট-রেস্তোরাঁ, বেকারি, আইসক্রিম পার্লার, ফাস্টফুডের দোকান সীমান্তের ওপারে খোলা থাকবে কিন্তু দোকানের সামনে বা দোকানের ভিতর বসে খাওয়া যাবে না । শুধু অর্ডার দিয়ে বাড়িতে নেওয়া যাবে । পশ্চিমা দেশগুলোও তা করেছে। বড় বড় রেস্টুরেন্টের সামনে লেখা আছে ওপেন বাট শুধু টেকঅ্যাওয়ের জন্য। নিয়ে যাবেন। কিন্তু সিলেটের জন্য এ ধরনের কোনো নির্দেশনা থাকছে কি?
টাকা জীবাণু ছড়ানোর একটা মাধ্যম বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা হচ্ছে, যে নগদ টাকার সংকট রয়েছে, ব্যাংকগুলো সীমিতভাবে চলছে, তাই নগদ টাকার লেনদেন অনেকটাই জটিল । সে কারণে আসামে সম্পূর্ণরূপে ই–কমার্স চালু রেখেছে। কিন্তু সিলেটে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা নেই।
ওপারে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ দোকান খোলা থাকবে, পুরোটা নয়। সুতরাং খোলা মানে পুরোটা খোলা নয়। আরে এপারে খোলা মানে পুরোটাই খোলা। ভেতর পর্যন্ত দেখা যাবে। এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে আবার নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকান যেমন গ্রোসারি, ফার্মেসি, খাতা বা কাগজের দোকানগুলো পড়বে না । এসব দোকান সব জায়গাতেই খোলা রাখা যাবে। বইয়ের দোকানের ক্ষেত্রে যে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছে, সে কথা আলাদাভাবে এপারে বলা হবে না।
প্রতিবেশী আসামে ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে বণিক সমিতির কর্মকর্তারা কথাবার্তা বলে ঠিক করবেন এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে কোন দোকানগুলো কোন কোন দিন খোলা থাকবে। তার মানে সবদিন নয়। কিন্তু এ ধরনের কোনো বৈঠকের প্রস্তুতি সিলেটে আছে বলে জানা যায় না।
এখানেই একটা খুশির খবর, সব খুলে দেওয়া হবে। সবকিছু খুলে দেওয়া হবে। ঘন দোকানপাটগুলোর জন্য আসামে আলাদা রীতি, রাস্তার দুই ধারে দোকান আছে। কিন্তু রাস্তার দুই ধারে থাকুক আর না থাকুক এ নিয়ে কোন বিভাজন তৈরি করার কোন পরিকল্পনা সিলেটে নেই। একথা জানা যায় না। অথচ ওপারে এক-তৃতীয়াংশ খোলার ফর্মুলা কি হবে, সে ব্যাপারেও সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পাশাপাশি তিনটি দোকানের মধ্যে একটি দোকান খোলা থাকবে । দুটি বন্ধ থাকবে। ঠিক একইভাবে পরেরদিন অন্য দোকান খুলবে। দুটি বন্ধ থাকবে। তৃতীয় দিন তিন নম্বর দোকান খুলবে । আর বাকি দুটো বন্ধ থাকবে। কিন্তু সিলেটে হাজার হাজার দোকান গাদাগাদি করে আছে। এগুলো খোলা মানে প্রত্যেকটি দোকান প্রতিমুহূর্তে খোলা থাকবে। সুতরাং সামাজিক দূরত্ব কেউ চাইলেও এটা রক্ষা করা বাস্তবে সম্ভব হবে না।
তাই দোকান খোলা সিলেটের জন্য মহা আতঙ্কের কারণ হবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিভাবে চলবে তাও ওপারে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে । যেমন একজন ড্রাইভার ও দুই জন যাত্রী নিয়ে অটোরিকশা ট্যাক্সি ইত্যাদি তিন চাকার বাহনগুলো রাজ্যের গ্রীন এলাকায় চলতে পারবে। তারা রেড জোন বা অরেঞ্জে যেতে পারবে না। সিলেটে এরকম এর কোন জোন–টোন হিসেবে প্রস্তুতি আছে কি? নাকি ভাগ্যের উপরেই সব ছেড়ে দেওয়া হবে? সূত্র- একাত্তরের কথা।