সিলেটের প্রাচীন ‘গড়’ কিভাবে ‘গৌড়’ হলো
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জুলাই ২০১৯, ৪:১৮ অপরাহ্ণ
এডভোকেট মুজিবুর রহমান চৌধুরী:
ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই জানেন ভারত সম্রাট কুতুব উদ্দিন আইবেকের তুর্কি বংশীয় প্রখ্যাত আফগান সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ পূর্ব ভারতের গৌড় রাজ লক্ষণ সেনকে বিতাড়িত করে ঐতিহাসিক গৌড়রাজ্য দখল করে গৌড়বঙ্গে মুসলিম আধিপত্যের সূচনা করেন। গৌড় রাজ্যের প্রখ্যাত রাজধানী গৌড় নগরীর ধ্বংসাবশেষ উত্তর বঙ্গের চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্তবর্তী ছোট ও বড় সোনা মসজিদসহ পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত শহর মালদহ এলাকায় আজও বিদ্যমান। মালদহ শহরতলীতে নির্মিত বিখ্যাত আদিনা মসজিদের পাশেই সেই এলাকায় ইসলাম প্রচারের জন্য আগত আরেক পীর শাহজালালের মাজার আছে। যা গৌড়িয় পীর শাহজালালের মাজার হিসেবে খ্যাত।
বখতিয়ার খিলজি ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে আসামেও অভিযান পরিচালনা করে রাজধানী গৌহাটি দখল করেন। যার উত্তরাংশে পাথরে খোদিত বিজয় স্মারক আজও বর্তমান। যা বিভিন্ন ইতিহাসেও উল্লেখ আছে। পরবর্তীতে পারস্যের তাব্রিজ শহর থেকে আগত আরেক প্রখ্যাত ইসলাম প্রচারক শেখ জালাল উদ্দিন তাব্রিজি ও বখতিয়ার খিলজির পথ ধরেই সেখানে গমন করে ইসলাম প্রচার করে ইন্তেকাল করেন। যার মাজার তীর্থস্থান হিসাবে সুপরিচিত। শেখ জালাল উদ্দিন তাব্রিজির সাথেই প্রখ্যাত মরোক্কিয় পরিব্রাজক ও পন্ডিত ইবনে বতুতা ১৩৪৬ সনে গৌহাটিতে গিয়ে সাক্ষাত করেন। যার বিস্তারিত বিবরণ ইবনে বতুতা নিজ বয়ানে লিখিত প্রখ্যাত ভ্রমণ কাহিনীতে বর্ণিত আছে।
অন্যদিকে ষোড়শ শতাব্দির মধ্য দিকে মোগল স¤্রাট আকবরের সেনাপতি মুনিম খান কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে গৌড়ের শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ কররানীর পাঠান সেনাপতি কতলু খাঁর বংশধরগণ ফতেহ খাঁন লোহানি, খাজা উছমান, ভুঁইয়া বায়োজিদ প্রমুখ পালিয়ে বঙ্গ-লাউড় ও ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় নিয়ে নিজ নিজ রাজ্য স্থাপন করেন। ফতেহ খাঁন লোহানি ত্রিপুরা মহারাজ্যে আশ্রয় নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যেরই পশ্চিম অংশে (যাকে ফার্সি-আরবি ভাষায় তরফ, যার বাংলা অর্থ অংশ, পক্ষ)। তরফ নামক আশ্রিত রাজ্য স্থাপন করে তা শাসন করতে থাকেন যা পরবর্তীতে তরফ রাজ্য নামেই ইতিহাসে খ্যাত হয়।
ঐতিহাসিক বাবু কমলাকান্ত গুপ্ত, অচ্যুৎ নারায়ন চৌধুরীসহ অনেকেই হঠাৎ এসে ত্রিপুরায় আশ্রয় নেন বলে ফতেহ খাঁন লোহানিকে ভুলবশত আচক নারায়ন নামে বর্ণনা করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। পরবর্তীতে তরফ শাসক ফতেহ খাঁন লোহানি তরফ রাজ্যের শাসনভার তারই বিশ্বস্ত সেনাপতি সৈয়দ মুসার উপর অর্পণ করে অন্য সেনাপতি সৈয়দ নাসির উদ্দিনকে নিয়ে ষোড়শ শতাব্দিরই মধ্য দিকে ছোট দ্বীপ রাজ্য উত্তর শ্রীহট্ট দখল করলে তথাকার সামন্ত শাসক রাজা গোবিন্দ কেশব দেব মাতা অপর্না দেবি, প্রতিবন্ধি পুত্র খগড় ও তাঁর নব বিবাহিতা স্ত্রী শান্তি দেবী এবং ভৃত্যসহ গোপনে দ্রুত নৌকাযোগে পলায়ন করে পশ্চিমের হিন্দু রাজ্য লাউড়ের হলহলিয়াস্থ গড়ের পাশেই নতুন বসতি স্থাপন করেন। একে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণগাঁও নামক বসতি গড়ে ওঠে যেখানে ইদানিং রাজা গোবিন্দের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ আজও বিদ্যমান।
বর্তমানে সেখানে সরকারের উদ্যোগে খনন কাজও চলছে। পথিমধ্যে ভয়ে প্রতিবন্ধি রাজপুত্র খড়গ প্রাণ হারালে বিধবা স্ত্রী শান্তি দেবির করুণ কাহিনী শান্তির বারমাসি নামক শোকগাথায় বর্ণিত আছে। অন্যদিকে রাজবৈদ্য মহিপতি দত্তের লাউড়ের রাজধানী জগন্নাথপুরের সন্নিকটে আশ্রয় নেন যার সুযোগ্য পুত্র প্রভাকরণ দত্ত পরবর্তিতে লাউড় রাজ বিজয় সিংহের মন্ত্রী হন এবং তাঁরই বাড়ি ঘিরে স্থাপিত জনবসতি আজো প্রভাকরপুর গ্রাম নামে খ্যাত এবং এদেরই এক অংশ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন যাদেরই কয়েকজন বাঙালি বংশীয় উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ সরকারি কর্মকর্তা আনোয়ার চৌধুরীসহ তাঁর উচ্চশিক্ষিত ব্রিটিশ নাগরিক ভাইয়েরা।
বর্ণিত রাজবৈদ্য মহিপতি দত্তের আরেক পুত্র কেশব দত্ত রাজা বিজয় সিংহের রাজবৈদ্য ছিলেন এবং তাঁরই বসত বাাড়িকে কেন্দ্র করে রাজধানী জগন্নাথপুরের কাছেই প্রভাকরপুর গ্রামের ন্যায় কেশবপুর নামক আরেক গ্রামও গড়ে ওঠে। এ কেশব দত্তের অধঃস্তন পুুরুষই প্রখ্যাত বাউল সাধক রাধারমন দত্ত যিনি আরেক বাউল সাধক হাসন রাজার কনিষ্ঠ সমসাময়িক ছিলেন এবং তাদের মধ্যে পত্র যোগাযোগসহ আন্তরিকতা ছিলো।
অন্যদিকে বর্ণিত কতলু খাঁর আরেক বংশধর খাজা ওসমান ভাটি বাংলার ময়মনসিংহের কেল্লা বোকাইনগর দখল করে ফার্সি ভাষায় নাম দেন একলেমিয়া মোয়াজ্জেমাবাদ বা পবিত্র অঞ্চল। কতলু খাঁর অন্য বংশধর ভুইয়ার বায়োজিদ প্রথমে বাংলার সুলতানের আশ্রয় থেকে পরবর্তীতে অর্থাৎ মোগল স¤্রাট আকবরের মৃত্যুর পর মোগল শক্তির সাময়িক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মোগল বশ্যতা স্বীকারকারী স্বগোত্রীয় ফতেহ খান লোহানিকে তাড়িয়ে ছোট দ্বীপ রাজ্য সিলেট দখল করেন এবং বাংলার প্রখ্যাত বারো ভুইয়ার বা সামন্তের অন্যতম একজন হিসাবে পরিণত হন। প্রসঙ্গত ফার্সি ও ধর্মীয় ভাষা আরবি ভাষী আর্য মুসলমানদের প্রভাবেই ছোট রাজ্য শ্রীহট্টের নামও ছিলাহেত বা সিলহেট এবং সংক্ষেপে সিলেট হলেও পরবর্তীতে ইংরেজদের আগমনের ফলে ইংরেজি ভাষায় সেই ফার্সি আরবি নাম ছিলাহেট-সিলহেট-ঝুষযবঃ লেখা হয়। উল্লেখ্য, ইংরেজি ভাষায়-ত-বর্ণ না থাকায় তৎস্থরে ট-বা-বর্ণ ব্যবহার করে ছিলাহাতের পরিবর্তে সিলহেট হয়েছে যা আজো প্রচলিত।
ফতেহ খান লোহানির সিলেট বিজয়ের খবর পেয়ে আফগানিস্তানের জালালাবাদ এলাকা থেকে দিল্লি হয়ে সোনারগাঁও আগত পীর হযরত শাহ জালাল নামক প্রখ্যাত সুফি সাধক শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রচারের জন্য তাঁর সঙ্গি সাথি নিয়ে সিলেটে এসে পালিয়ে যাওয়া রাজা গোবিন্দের গড় এলাকায়ই বসতি স্থাপন করেন যার নাম হয় পীরমহল্লা। তার মৃত্যুর পর তাকে কাছের টিলায় দাফন করা হয় যা হযরত শাহজালালের দরগা শরীফ এবং এ দরগা শরীফকে কেন্দ্র করে যে বসতি গড়ে ওঠে তা দরগা মহল্লা নামে খ্যাত। এখানে উল্লেখ্য, আসামের গৌহাটিতে সমাধিস্থ হযরত জালাল উদ্দিন তাব্রিজি (রা.) সিলেটে সমাধিস্থ হযরত শাহ জালাল (রা.) এর আগমনের সময়ের পার্থক্য প্রায় দু’শত বৎসর। তাই উভয়কে এক করা বিভ্রান্তিমূলক কারণ উভয়েরই রওজা শরীফ গৌহাটি ও সিলেটে যথাযথ ভাবে আজো বিদ্যমান এবং ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এলাকা ও দেশ বাসীর শ্রদ্ধার স্থান।
শ্রীহট্ট শহরের উত্তর দিকে টিলা টুলি বেষ্টিত এলাকায়ই রাজা গোবিন্দের গড় বা দূর্গ ছিলো যে এলাকায় বর্তমান হাউজিং এস্টেট, মজুমদারি, পীর-মহল্লা, চৌকিদেখি ইত্যাদি এলাকা বিদ্যমান এবং তৎউত্তরে বড় শালা এলাকায় রাজ কর্মচারীদের বাসস্থান ছিলো। বর্তমান আম্বরখানা বাজারের লাগোয়া উত্তরাংশকে আজো গড় দোয়ার যা রাজার গড় বা দূর্গের প্রবেশ দ্বার ছিলো এবং পুরানো দলিলেও এ এলাকাকে মহল্লে গড় দোয়ার হিসাবে উল্লেখ আছে। লাগোয়া পশ্চিমেই রাজ বৈদ্য চক্রবানী দত্ত ও তৎপুত্র মহীপাতি দত্তের বাসস্থানকে ঘিরে গড়ে ওঠা বসতি দত্তপাড়া আজও বিদ্যমান। এলাকার লাগোয়া পূর্ব দিকে এলাকার পানি সমস্যা সমাধানের জন্য রাজা তাঁর মায়ের নামে যে দীঘি খনন করান তা আজো রাজার মার বা রাণীর দীঘি নামে খ্যাত যদিও বর্তমানে তা ভরাট হয়ে বাসা বাড়ি হচ্ছে। শহরের পূর্ব দিকে টিলার উপর খাসিয়াদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে শহর রক্ষার জন্য রাজা গোবিন্দ আরেকটি দূর্গ বা গড় গড়ে তোলেন এবং যাকে কেন্দ্র করে পরে বসতি গড়ে যা টিলাগড় এলাকা নামে পরিচিত। এ টিলার উপরই পরবর্তিতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজস্ব আদায়কারী কালেকটার উইলিয়াম থেকারেরও বাসস্থান ছিলো বলে এ টিলাকে আজো থেকারের টিলা নামে পরিচিত। এখানেই বর্তমানে এমসি কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবন বিদ্যমান এবং এখান থেকে দূরের এলাকাও পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। রাজা গোবিন্দের মূল দূর্গ বা গড়ের সাথে যুক্ত এলাকার দুটি প্রধান রাস্তা রাজারগলি ও দর্শন দেউড়ি আজো সর্বজন পরিচিত। রাজারগলি দিয়ে রাজা তাঁর আরাধ্য দেবতা ইট্টনাথের বিগ্রহ ও মন্দির দর্শন করতেন যার ধ্বংসাবশেষ শহরের দরগা গেইটস্থ কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের বাণিজ্যিক ভবনের নীচ তলায় এখনও সংরক্ষিত আছে। ইট্টনাথের মন্দিরের সেবায়েত প্রখ্যাত নাথ গুরু মন্মথ নাথের আখড়া পাশের পূর্ব দিকের উচু টিলায় ছিলো যেখানে বর্তমানে জেলা জজের বাসস্থান। এর লাগোয়া পূর্বের টিলায় ছিলো রাজা গোবিন্দের মন্ত্রী মনা রায়ের বাসস্থান যাকে আজও মনা রায়ের টিলা বলা যায়, যেখানে বর্তমানে সরকারি প্রকৌশলীর বাসস্থান। পরবর্তীতে নির্মাণ কাজের জন্য খনন কালে বর্ণিত আশ্রমের সন্ন্যাসিদের ব্যবহৃত গাজা ও ভ্যাং সেবনের পুরানো তৈজসপত্রাদি পাওয়া গিয়েছিলো।
এখানে উল্লেখ্য রাজা গোবিন্দের আমলের একমাত্র মুসলমান হযরত বোরহান উদ্দিন, বিক্রমপুরের রাজা বল্লাল সেন এবং তরফ রাজ আচক নারায়ন যিনি আসলে বর্ণিত ফতেহ খাঁন লোহানি এর সময়ের সেখানকার কাজি নুরুদ্দিন প্রমুখ কর্তৃক গরু জবাইয়ের একই রকম অপরাধের কারণে পরবর্তিতে যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদি কাহিনী জনশ্রুতি মাত্র।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে আগ্রহি রাজা গোবিন্দের সময় সিলেট পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বিপের পরেই সংস্কৃত চর্চার কেন্দ্র ছিলো। রাজা গোবিন্দের সাথে পীর হযরত শাহজালালের (রা.) যুদ্ধের যে জনশ্রুতি আছে তা বাস্তবে ছিলো সিলেটের পরবর্তী পাঠন শাসক ভুইয়া বায়োজিদের সাথে তদানিন্তন যুগে বাংলার প্রখ্যাত সুবেদার ইসলাম খাঁন চিশতীর সেনাপতি কামালের সাথে কয়েক দিনের যুদ্ধের বিবরণ। এ যুদ্ধের মাধ্যমেই মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের বঙ্গিয় সুবেদার ইসলাম খান সিলেটে পুনরায় মোগল আধিপত্য স্থাপন করেন। এ যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ ইসলাম খাঁন নৌ সেনাপতি মির্জা নাথান লিখিত বাহারিস্থানে গায়েবি ইতিহাস বইতে রয়েছে যা বিভিন্ন কারণে অনেক দেরীতে প্রকাশিত হওয়ার কারণে বিভিন্ন ভিত্তিহীন জনশ্রুতি প্রাধান্য পেয়েছিলো। তদুপরি রাজা গোবিন্দের সাথে হযরত পীর শাহজালালের (রা.) কথিত যুদ্ধে যে সকল অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছে তা সত্য ও বিজ্ঞান সম্মত নয় এবং আরব ও ইসলামের সুদীর্ঘ ইতিহাসে ঐসব অলৌকিক ঘটনার কোন নজির নেই। নেই ইসলাম ধর্মের মহান প্রচারক হযরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক পরিচালিত বদর-ওহুদ প্রভৃতি মহান যুদ্ধেও।