শূন্য থেকে কোটিপতি সিলেটের সেই বশর
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জুলাই ২০১৯, ৮:০৬ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক :
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শাহ আরেফিন টিলা। হযরত শাহজালালের (রাহ.) সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার মধ্যে অন্যতম হযরত শাহ আরেফিনের (রাহ.) স্মৃতিধন্য এ টিলার নামকরণ করা হয় তার নামেই। পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের প্রায় ৩৫৭ একর ভূমি জুড়ে বিস্তৃত এ বিশাল টিলার অবস্থান। ধারণা করা হয় দু’শ ফুট উচ্চতার এ টিলাটির বয়স ৭শ বছরের মতো। মাত্র কয়েক বছর পূর্বেও শতশত ভক্ত-আশেকান এ টিলায় সমবেত হতেন নিয়মিত। ভক্তদের দোয়া ও জিকির আজগারের প্রতিধ্বনিত টিলার বাতাসে। প্রতিবছর হযরত শাহ আরেফিনের (রাহ.) ওরস সহ বিভিন্ন উৎসব পালিত হত এখানে। ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ টিলায় একসময় বাঘসহ বিভিন্ন প্রাণীর অবাধ বিচরণ ছিল বলেও স্থানীয়দের ভাষ্য। কিন্তু কালের বিবর্তনে টিলার আগের রূপ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। টিলা কেটে তৈরি করা হয়েছে বিশাল বিশাল গর্ত। সেই গর্ত থেকে প্রতিদিন উত্তোলন করা হচ্ছে পাথর।
শাহ আরেফিন টিলার পাশে গড়ে উঠা বাজারের পাশে জালিয়ারপার গ্রামের ছোট্ট মাটির একটি ঘরে বসবাস করতেন বশর মিয়া। ছোটখাটো একটি হাস-মুরগির ফার্ম ছিল তার। সারাদিন ফার্মের দেখাশোনার পর সন্ধ্যায় মদ-গাঁজার আসর বসাতেন। সে আসরে গান বাজনাও হত। যাত্রাপালা সহ বিভিন্ন ধরণের শখও ছিল বশর মিয়ার। কয়েক বছর পূর্বে কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ কোয়ারির পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে গেলে পাথরের সংকট দেখা দেয়। চাহিদা বাড়ে শাহ আরফিন টিলার পাথরের। এ সুযোগে পাথরের সন্ধানে ৭ ভাই ও পিতা শুক্কুর আলীকে নিয়ে জায়গা দখলে নামেন বশর মিয়া। ক‚টচাল-কৌশলে ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে বশর মিয়া। বশর মিয়া হয়ে উঠেন কোম্পানীগঞ্জের বশর কোম্পানি। প্রতিদিন রাজ্য বিস্তৃত হতে থাকে বশর মিয়ার। ভয়ভীতি দেখিয়ে স্থানীয় ভোগদখলকারীদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে কিনে নিতে থাকেন টিলার জমি। কেউ বিক্রি করতে না চাইলে জোর পূর্বক তাকে উচ্ছেদ করা হত। করা হত অকথ্য নির্যাতন। বশর কোম্পানির ভয়ে বহু লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। শাহ আরেফিন টিলার ৩৫৭ একর জমির মধ্যে ৩০০ একরের বৈধ ও অবৈধ দখলদার বর্তমানে সে। সেই জমি থেকে পাথর উত্তেলন করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন বশর কোম্পানী। শাহ আরেফিন টিলার পাথর কোয়ারি নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি বিশাল ও শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটই নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় পাথরখেকো কয়েকটি গ্রুপকে। এই সিন্ডিকেটের মূল কারিগর বশর মিয়া। বশর কোম্পানি নামে পরিচিত বশর মিয়ার ছত্রছায়ায় অবাধে চলে পাথর লুটপাট। ২০০ ফুট উচু টিলার চিহ্ন মাত্র অবশিষ্ট নেই আর।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় পাথরখেকো গ্রুপের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে বশর কোম্পানী গ্রুপ। প্রায় এক যুগ ধরে ধীরে-ধীরে বিশাল আকৃতির ওই টিলা কেটে পাথর উত্তোলন করে সাবাড় করেছে বশর ও তার বাহিনী। বশর মিয়া তার নিজের গ্রুপ ছাড়াও সিন্ডিকেটভুক্ত আরো চারটি গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণ করে। শাহ আরফিন কোয়ারি এলাকায় রয়েছে বশরের প্রায় দেড় শ’ গর্ত। এসব গর্ত থেকে প্রতিদিন বশর নিজেই আয় করে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা।
এক সময় বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকা বশর মিয়া ২০১৬ সালে দল বদল করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। অভিযোগ রয়েছে, কোয়ারির অন্যতম নিয়ন্ত্রক হিসেবে বশর মিয়া প্রশাসনের সঙ্গেও লেনদেনের বিষয়টি দেখভাল করে। বশর মিয়া কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। শাহ আরেফিন বাজারে নির্মাণ করেছেন তিন তলা ভবন। কোম্পানীগঞ্জে জনশ্রুতি, বশর মিয়া নিজেই জানে না তার সম্পদের হিসেব। বশর কোম্পানীর নামে পাথর বহনকারী শতাধিক ট্রাক্টর চলাচল করে রাস্তায়। শাহ আরফিন টিলার বেশিরভাগ পাথরের গর্তের ‘মালিক’ বশর মিয়া। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার পাথর উত্তোলন হয় তার গর্ত থেকে। গত কয়েক বছরে শাহ আরফিন টিলায় পাথর চাপায় অন্তত ২৫ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগ শ্রমিকই নিহত হয়েছেন বশর মিয়ার গর্তে। বশর মিয়া এসব মৃত্যুও ম্যানেজ করে নেন। স্থানীয় প্রভাবশালী সরকারদলীয় নেতার ছত্রছায়ায় শাহ আরফিন কোয়ারির একক নিয়ন্ত্রক বশর তার বাহিনীর দ্বারা শাহ আরফিন, ছনবাড়ি এলাকায় কায়েম করেছেন ত্রাসের রাজত্ব। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা। হুলিয়াও রয়েছে মাথায়। বেশ কয়েকবার তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করলেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে প্রতিবারই পালিয়ে যেতেন বশর মিয়া। তবে এবার আর শেষ রক্ষা হয়নি। বন্দি হয়েছেন র্যাবের খাঁচায়। বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় কোম্পানীগঞ্জের শাহ আরফিন বাজারের নিজস্ব বাসা থেকে বশর কোম্পানীকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৯। এসময় কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশের একটি টিম র্যাবকে সহযোগিতা করে। বশর কোম্পানীকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-৯ এর উইং কমান্ডার মো. আসাদুজ্জামান। ৬টি মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী বশর মিয়া। এছাড়া কোম্পানীগঞ্জ থানায় হত্যা মামলাসহ মোট ১৩ টি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-৯ ও কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশের যৌথ অভিযানে বশরকে একটি পাইপগান ও এক রাউন্ড গুলিসহ গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তাকে কোম্পানীগঞ্জ থানায় হস্তান্তর করে র্যাব। ওসি জানান, বশর মিয়া একাধিক মামলার ওয়রেন্টভূক্ত আসামী। পুলিশ বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র মামলা দায়ের করেছে। আজ আদালতে তোলা হবে কোম্পানীগঞ্জের আলোচিত বশর কোম্পানিকে।
বশর মিয়ার অন্য একটি পরিচয়ও আছে। চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসীর বাইরে তার শখ হচ্ছে অভিনয়ে। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় নির্মিত বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয়ও করেছেন তিনি। ‘কটাই মিয়া’খ্যাত শাহেদ মোশাররফের সাথে জুটি বেধে অভিনয় করেছেন ‘সুখে দুঃখে পাশে থাকব’, ‘জিহাদ ঘোষণা’ ‘কালা বাচ্চা লাল গাই’সহ বেশ কয়েকটি ‘সিলেটি’ নাটকে।
শাহেদ মোশাররফকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, প্রায় তিন বছর আগে এক ছোটভাইয়ের মাধ্যমে বশর মিয়ার সাথে পরিচয়। তিনি নাটকে অভিনয়ের আগ্রহ প্রকাশ করলে আমরা বেশ কয়েকটি নাটকে এক সাথে অভিনয় করি। এর মধ্যে জিহাদ ঘোষণা নাটকটি বশর মিয়ার নিজ এলাকা শাহ আরফিন টিলায় চিত্রায়িত হয়। আমি তাকে একজন পাথর ব্যবসায়ী হিসেবেই জানি। অভিনয়ের বাইরে তার সাথে আর কোনো সম্পর্ক নেই। সুত্র-একাত্তরের কথা।