ঐতিহ্যের সিলেট
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:৩০:৫৮,অপরাহ্ন ১৩ জুলাই ২০১৯
মোহাম্মদ আব্দুল হক:
আমি বাঙালি এবং বাংলাদেশী। এমন উচ্চারণ আমার মুখ থেকে যেভাবে সহজে বের হয়, ঠিক তার পরেই যে সহজ সরল কথাটি আমি তাড়াতাড়ি বলে ফেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, তাহলো আমরা সিলেটি। সত্যি বলতে কি, সিলেটি শব্দটির উচ্চারণ বৃহত্তর সিলেটের মৃত্তিকায় যুগ যুগ ধরে এমনকি শতাব্দীর শিকড় প্রোথিত সামাজিক মানুষের মুখে যতোটা আবেগ ও মমতা জড়িয়ে প্রকাশিত হয় তা কখনো অন্যদের মুখে সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই যে ‘আমরা সিলেটি’ এই শব্দ দু’টি অন্যদের মুখে এতোটা প্রাঞ্জল ভাষায় ফুটে না। স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রের দিকে লক্ষ্য করলে উত্তর-পূর্বকোণ অর্থাৎ ঈশান কোণে যে বিভাগটি চোখে পড়ে সেটি হলো সিলেট বিভাগ। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ এই চারটি জেলা নিয়ে সিলেট বিভাগের আমরা দেশের ভিতর কিংবা বিদেশে যেখানেই যাই আমরা সিলেটি কথাটি প্রাণভরে বলে উপভোগ করি। এই সিলেটের আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এর কিছু কিছু আমাদের মাঝে মাঝেই স্মরণ করা দরকার। এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে কিছুটা আলোকপাত করছি।
আমরা যদি সিলেট নামের কথায় আসি তাহলে সেখানে খুঁজে পাই, সিলেট নামটি শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠিত ছিলো না অথবা সিলেট নামটি হঠাৎ হয়ে ওঠেনি। প্রাচীন কাল থেকে এতোদঞ্চলের নাম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে উচ্চারিত হয়ে এসেছে। তবে তৎকালীন কোনো নামই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বরং অনেক পরে সিলেট নামটি ঐতিহাসিক ভিত্তিতে শক্ত ভিত্তি নিয়ে টিকে আছে। ইতিহাসের আলোকে জানা যায়, প্রাচীনকালে প্রখ্যাত চীনা বৌদ্ধ ধর্মীয় পন্ডিত এবং বিশ্ববিখ্যাত পরিব্রাজক হিউয়েন সঙ ৬৪১ খ্রীষ্টিয় সালে জলপথে এই অঞ্চলে এসেছিলেন। তখন তিনি আমাদের এই অঞ্চলকে ‘শিলা চটলো’ নামে আখ্যা দিয়েছিলেন। আবার ১৩০৩ সালে হযরত শাহজালাল (রহ.) ৩৬০ জন আউলিয়া নিয়ে এ অঞ্চলে আসেন। তখন তিনি শেষ স্বাধীন অত্যাচারী হিন্দু রাজা গোবিন্দকে পরাজিত করলে এ অঞ্চল মুসলমানদের দখলে আসে এবং সে কারণে লোকমুখে তিনশ ষাট আউলিয়ার দেশ বলে এ অঞ্চলকে বুঝানো হয়। হযরত শাহজালাল (রহ.) সিলেটে এসেছিলেন বলে আমাদের এই জনপদ ‘জালালাবাদ’ নামেও পরিচিত হয়েছিলো। কথিত আছে, হযরত শাহজালাল (রহ.) সিলেটে প্রবেশের পথে তৎকালীন রাজা গৌড় গোবিন্দ বড় বড় পাথর খন্ডের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন। আর তখন হযরত শাহজালাল (রহ.) পাথরের প্রতিবন্ধকতা সরানোর জন্য ‘শিল হট’ বলে আদেশ দেন। এই ‘শিল হট’ অর্থ পাথর সরে যাও। সেই থেকে অঞ্চলের নাম মানুষ ‘সিলহট’ নামেও জানতো। বিশ্ব বিখ্যাত আরেক পর্যটক শেখ আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে বতুতা সিলেট এসেছিলেন মরক্কো থেকে ১৩৪৬ সালে এবং এ অঞ্চলের নাম ‘কামরূপের বনভূমি’ বলে চালিয়েছেন। এছাড়াও এ অঞ্চল যখন বিট্রিশ শাসনাধীন তখন ব্রিটিশরা একে সিলহেট নামকরণ করেছিলো। এভাবে কালক্রমে আমাদের এ অঞ্চল ‘সিলেট’ নামে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে।
শুধু তাই নয়। এমন এক ঐতিহাসিক সিলেটের ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অফুরান। এখানে সারা দেশের মানুষ বেড়াতে আসে, জানতে আসে। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়নি তারও অনেক আগে ১৮৯২ সালে রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় তাঁর মাতামহের নামে মুরারী চাঁদ কলেজ স্থাপন করেন যা এমসি কলেজ হিসেবে ভারত উপ মহাদেশে বহুল পরিচিত। এই এমসি কলেজ তৎকালীন আসাম প্রদেশের প্রথম কলেজ। এটি আমাদের সিলেটের ঐতিহ্য। বৃহত্তর সিলেটে এমন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যা শতবর্ষের ঐহিত্য নিয়ে টিকে আছে। সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় ১৮৮৭ সাল থেকে এখনো সুনামের সাথে টিকে আছে সুরমা নদীর তীরে। ১৯৩৬ সালে সুনামগঞ্জের আতুয়াজান পরগনার পাইলগাঁওয়ের প্রজাহিতৈষী জমিদার রসময় চৌধুরীর তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন ছেলে আইনজীবী ও সাহিত্যিক ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর উদ্যোগে সিলেট মহিলা কলেজ স্থাপিত হয় যা এখন সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌহাট্টায় গৌরবের সাথে অবস্থান করছে। আমাদের সিলেটের দু’টি ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক নির্দশন হলো সুরমা নদীর উপর কীন ব্রিজ এবং নদীর তীরে কীন ব্রীজ সংলগ্ন সুবিশাল আলী আমজদের ঘড়ি। কীন ব্রিজ নির্মাণ করেছিলেন সিলেটের তরফ পরগনার মীরাশী গ্রামের ভারত চন্দ্র দত্ত এর পুত্র তৎকালীন আসাম প্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী প্রমোদ চন্দ্র দত্ত। আর ঘড়িটি স্থাপন করেন ১৮৭৪ সালে সিলেটের পৃথ্বিমপাশার বিখ্যাত জমিদার আলী আমজদ খাঁ। এই সিলেটে আছে ১৬৭০ সালে নির্মিত এক ঈদগাহ যা সিলেটের শাহী ঈদগাহ নামে সারাদেশে বহুল পরিচিত। এই ঈদগাহ নির্মাণে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন মোগল ফৌজদার ফরহাদ খান। এমনি সব ঐতিহ্য ধারণ করে আছে আমাদের সিলেট।
এই বাংলাদেশের একমাত্র সিলেটিদের আছে নিজস্ব বর্ণমালা যা সিলেটি নাগরী লিপি নামে পরিচিত। সিলেটে এখন নাগরী ভাষা শিক্ষার জন্য সিলেটের বিশিষ্টজন, শিক্ষানুরাগী, বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর খ্যাত রাগীব আলী সিলেট শহরে রাগীব-রাবেয়া নাগরী ইন্সটিটিউট গড়ে তোলেছেন। এটি নাগরী ভাষা চর্চা ও গবেষণায় বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান। সাহিত্য চর্চা ক্ষেত্রেও আমাদের সিলেটের রয়েছে গৌরবময় ঐতিহ্য। কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, সিলেট ১৯৩৬ সালে যাত্রা শুরু করে। এটি শুধু সিলেটের ঐতিহ্য নয় বরং বলা যায় দেশের অন্যতম প্রাচীন এক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু থেকেই ধারাবাহিকভাবে ‘আল ইসলাহ’ নামে একটি অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে আসছে। এটিই এখনো বাংলাদেশের একমাত্র প্রাচীন পত্রিকা যা এখনও প্রকাশিত হয় কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, সিলেট থেকে। সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, হযরত শাহজালাল (রহ.) এর মাজার এর পূর্ব দিকের গেইটের দক্ষিণ পার্শ্বে দৃষ্টিনন্দন এক ভবন। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই ভবনটির সৌন্দর্য পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সহজে। এটি মূলত একটি পাঠাগার। এই পাঠাগারে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বই সংরক্ষিত আছে, যা সিলেটের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা এবং সাহিত্যামোদীদের জ্ঞান পিপাসা মিটিয়ে থাকে। আমাদের বৃহত্তর সিলেটের সর্বত্র ছড়িয়ে আছেন মরমি কবি এবং বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যাদের কথা আমরা সিলেটবাসী গৌরবের সাথে বলে থাকি। হাসন রাজা, রাধা রমন, শাহ আব্দুল করিমের গান বিদেশেও সমাদৃত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী আমাদের সিলেটের সন্তান এবং বাংলাদেশের গৌরবের বিজয়ের এক উজ্জ্বল অংশ। রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব হবিগঞ্জের শাহ এ এম এস কিবরিয়া, মৌলভীবাজারের এম সাইফুর রহমান, সুনামগঞ্জের আব্দুস সামাদ আজাদ, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, সিলেটের হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, আবুল মাল আব্দুল মুহিত এবং আরো অনেকে আছেন যারা সারাদেশে অতি পরিচিত।
এছাড়া সিলেটের প্রাকৃতিক সম্পদ ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আছে পৃথিবী জুড়ে খ্যাতি। জানেন তো মুর্তা বেতের তৈরি সিলেটের শিতল পাটি আজ বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। সিলেট ও মৌলভীবাজারের চা-বাগান দেখতে প্রতিদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ আসেন। আমাদের সিলেট বিভাগের বিস্তীর্ণ এলাকা হাওর সমৃদ্ধ। বর্ষায় এর অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে সারাদেশ থেকে ছুটে আসেন ভ্রমণ পিপাসী মানুষ। কে না জানে আমাদের হাকালুকি, টাঙ্গুয়ার হাওর, শনির হাওরের কথা। এগুলো হচ্ছে হাজার প্রজাতির মাছের বাড়ি। আমাদের সিলেটের রয়েছে ছোট বড় অনেক নদী। এর মধ্যে সুরমা ও কুশিয়ারা অন্যতম। সুরমা নদী বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী। ভারতের মণিপুর পাহাড়ে উৎপত্তি একটি নদী হলো বরাক, বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সুরমা ও কুশিয়ারা নাম নিয়ে। সুরমা নদী সিলেট অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে ছুটেছে সিলেট ও সুনামগঞ্জ শহর ছুয়ে অনেক ধানক্ষেত, বিল ও হাওরের পুষ্টির যোগান দিয়ে।
এই সুরমা নদীই চলতে চলতে আবার কুশিয়ারাকে সাথে নিয়ে হবিগঞ্জে কালনী নামে কিছু দূর এগিয়েছে এবং পরে মেঘনায় মিলেছে। সুরমা নদীর উৎস ভারতের বরাক হলেও এ নদী শেষ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। আমি ও আমরা সিলেটের মানুষ সুরমা নদীকে খুব ভালোবাসি। তবে দুঃখজনক সত্য হলো আমাদের একশ্রেণির মানুষের অবহেলায় আমাদের এই নদী তার অতীত গৌরব হারাতে বসেছে। মনে রাখতে হবে এ নদীকে মেরে ফেলার অধিকার আমাদের নেই। এতে প্রকৃতি আমাদের উপর বিরূপ আচরণ করবে। ঠিক তেমনি আমাদের কোনো অতীত ঐতিহ্য ধ্বংস করা যাবে না। কারণ ঐতিহ্য হারালে জাতিসত্ত্বার মূলে আঘাত লাগে। আত্মপরিচয়ের জায়গাটুকু হারিয়ে যায়।
প্রিয় পাঠক, এখানে আমি অল্প কিছু তুলে ধরেছি। তবে এই অল্প জানার মাধ্যমে আমরা সিলেট সম্পর্কে আরো বেশি জানতে সচেষ্ট হলে মূলত বাংলাদেশকেই জানা হবে। এই সিলেট বাংলাদেশেরই অংশ। এর ঐতিহ্য বাংলাদেশেরই ঐতিহ্য। তারপরও প্রতিটি অঞ্চলের মানুষের তার নিজের সংস্কৃতি ঘেঁষে থাকা এলাকায় আলাদা টান অনুভব করে। এ টান শিখড়ের টান। আমরা সিলেটি হিসেবে সিলেটের আরো আরো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের খোঁজ রাখার পাশাপাশি আমাদের দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের খুঁজ রাখবো। আমরা যেনো আমাদের ঐতিহাসিক নিদর্শন ও ঐতিহ্য না ভুলি এবং আমাদের দ্বারা যেনো আমাদের প্রকৃতি, ঐতিহাসিক স্থাপনা ও ঐতিহ্য ধ্বংস না হয়।