সিলেটেও গুজব : পদ্মা সেতুতে ‘মাথা’ লাগবে!
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জুলাই ২০১৯, ৩:২৯ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
পদ্মা নাকি চেয়েছে মানুষের মাথা। কেউ বলেছেন এক লাখ, কেউ বা তার চেয়ে কম বেশী মাথার সংখ্যা বলেছেন।
এমন গুজব ছড়াচ্ছে সিলেটেও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত গর্দনা গ্রামের একজন বলেছেন, তাদের গ্রামে নাকি কল্লা কাটরি (ছেলে ধরা) এসেছিল। গ্রামবাসীর ধাওয়ায় নাকি পালিয়ে গেছে।
অমুক বলেছেন, তমুক জায়গা থেকে একটি শিশুকে ধরে নিয়ে গেছে। এমন গুজব শুনা যাচ্ছে শহরতলী আর গ্রামীণ জনপদে।
গুজবে ভাসছে দেশ। ছেলেধরা, কল্লাকাটাসহ স্থানীয় প্রচলিত ভীতিকর নানা মিথ্যা-বানোয়াট কথা বলে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে সমাজে। এ কারণে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন অভিভাবকরা। ভয়ে বাড়ির বাইরে যাচ্ছে না অনেক শিশু। দেশের গৌরব পদ্মা সেতু নির্মাণে ‘মানুষের মাথা ও রক্ত লাগবে’ এমন মিথ্যা গুজব রটিয়ে সমাজে ভয়ানক আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে একটি চক্র। সেই গুজবেই এখন মুখরিত ফেসবুক ও ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সূত্রপাত ঘটা এ গুজব এখন চরম সামাজিক বিশৃঙ্খলায় রূপ নিয়েছে।
জানা গেছে, গত দুই-তিন দিনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে বেশ কয়েকজন গণপিটুনির শিকার হয়েছে। এমনকি হত্যাকান্ডেরও শিকার হয়েছেন কয়েকজন। অথচ, গণপিটুনি ও হত্যার শিকার মানুষদের অধিকাংশই মানসিক ভারসাম্যহীন বলেও জানা গেছে। এরই মধ্যে শুক্রবার সারা দেশে পদ্মা সেতু নিয়ে ওইসব গুজব ছড়ানোর অভিযোগে অন্তত ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সেতু বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলেছেন, কোনো সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা বা রক্ত লাগার মতো বিষয় সম্পূর্ণ বানোয়াট, কাল্পনিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সরকারবিরোধী কোনো চক্র অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে ‘এক লাখ শিশুর মাথা কেটে তৈরি হচ্ছে পদ্মা সেতু’ বলে সমাজে এ ভীতি ছড়াচ্ছে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিশুরা যাতে মানসিকভাবে ক্ষতগ্রস্ত না হয় সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে। আবার এ গুজবের সুযোগে যেন পেশাদার অপরাধী বা অপহরণকারী চক্র তৎপরতা না চালাতে পারে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা এ প্রসঙ্গে সময়ের আলোকে বলেছেন, কিছু ব্যক্তি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা ও রক্ত লাগবে বলে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করছে। এটি পুরোপুরি মিথ্যা ও গুজব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা এ ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে সারা দেশে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ এ গুজবের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে গত ১০ জুলাই বিকাল থেকে ফেসবুকে প্রচারণা শুরু করেছে। এআইজি সোহেল রানা বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি জড়িত। একটি মহল এ উন্নয়ন ব্যাহত করতে এ ধরনের গুজব রটিয়ে দেশবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, যা গুরুতর অপরাধ। অনেকে না বুঝেই এটি শেয়ার করে অপরাধের অংশীদার হচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক সময়ের আলোকে বলেন, সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা বা রক্ত লাগার এমন কাল্পনিক বানোয়াট কথা অনেক আগে থেকেই সমাজে রটে আছে। সম্প্রতি নতুন করে দেশের গৌরবের স্মারক পদ্মা সেতু নির্মাণেও এমন ধরনের গুজব কোনো সামাজিক বিশৃঙ্খলার উদ্দেশ্যেই ছড়ানো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ গুজব প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে। কেননা এ ধরনের গুজব থেকে অনেক সময় সমাজে বা রাষ্ট্রে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা বা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা হতে পারে। এ ধরনের গুজব মানুষ হত্যারও হাতিয়ার। এ ছাড়া এ গুজবকে অনেক সময় সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারে অপরাধী বা অপহরণকারী চক্র।
গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেফতার ৬ : পদ্মা সেতুর নির্মাণ নিয়ে ফেসবুকে ওইসব গুজব ছড়ানোর অভিযোগে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। শুক্রবার দুপুরে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সিনিয়র সহকারী পরিচালক এএসপি মিজানুর রহমান ভুইয়া জানান, পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে গুজব ছড়ানোর দায়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে শহীদুল ইসলাম সোহেল (২৫) নামে এক তরুণকে নড়াইল থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৬ ব্যাটালিয়ন, আরমান হোসাইনকে (২০) চট্টগ্রাম থেকে র্যাব-৭, মো. ফারুককে (৫০) নামে এক ব্যক্তিকে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৯ এবং রাজবাড়ীর পাংশা থেকে পার্থ আল হাসান (১৬) নামে এক কিশোরকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৮-এর সদস্যরা। এ ছাড়া শুক্রবার সকালে কুমিল্লার লাকসাম থেকে হায়াতুন্নবী (২৫) নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে র্যাব-১১ ব্যাটালিয়ন। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা করা হয়েছে।
ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি-হত্যা : পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে মানুষের মাথা লাগবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এমন গুজবে গলাকাটা, বস্তাওয়ালা কিংবা ছেলেধরা বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনি বা হত্যার ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার ভোর রাতে পটুয়াখালী সদর উপজেলার গেরাখালী এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে দাদন মিয়া (৫৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। নিহত দাদন মিয়া মাদারীপুরের ডিগ্রিরচর এলাকার বাসিন্দা মোহন মিয়ার ছেলে। যিনি মানসিক ভারসাম্যহীন বলে পুলিশ জানিয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার চাঁদপুর সদরের ইসলামপুর গাছতলা এলাকায় মনু মিয়া (৪০) নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তিকে বেধড়ক মারধর করেছে স্থানীয় জনতা। এ ছাড়াও ছেলেধরা সন্দেহে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে এলাকাবাসী। মোহাম্মাদপুরে এক নারীকে একই সন্দেহে বেদম মারধর করা হয়। পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। এ ছাড়া, লক্ষীপুর জেলার দালাল বাজারে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে পুলিশে দেয় জনতা। ছেলেধরা সন্দেহে মারধরের এরকম আরও খবর পাওয়া যাচ্ছে।
পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এটি একটি গুজব। এর কোনো সত্যতা নেই। এমন অপপ্রচার আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য দেশবাসীকে অনুরোধ করা যাচ্ছে।
যেভাবে গুজব ছড়ালো : ২০১৫ সালের ১ মার্চ নদীতে পশুর রক্ত ঢেলে পদ্মা সেতুর ভিত্তিস্থাপন কাজের উদ্বোধন করে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় মূল সেতুর পরীক্ষামূলক ভিত্তি স্থাপনের সময় নদীতে গরু ও খাসির রক্ত ঢালে চাইনিজ ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। ভাসিয়ে দেওয়া হয় কয়েকটি মুরগিও। তাদের বিশ্বাস, বড় কাজের শুরুতে পশু উৎসর্গের মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, এড়ানো যায় বড় দুর্ঘটনা। তখন এ বিষয়টি গণমাধ্যমেও সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই সময়ের রক্তের ছবি এখন ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে একটি কুচক্রিমহল।