সিলেটজুড়ে পানিবন্দি মানুষ, প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জুলাই ২০১৯, ১২:০১ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
পাহাড়ি ঢল ও ক’দিনের টানা বর্ষণে সিলেট অঞ্চলে দ্রুত বাড়ছে বন্যার পানি। এ অঞ্চলের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত প্রধান দু’নদী সুরমা ও কুশিয়ারাসহ সবক’টি নদ-নদীরই পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক গ্রামে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। হাওরের জনপদ সুনামগঞ্জে শুক্রবার বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী- সিলেটে সুরমা ও কুশিয়ারাসহ বড় নদীগুলোর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শুক্রবার দুপুর ১২টার রিডিং অনুযায়ী সিলেটে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ১০ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার ও কানাইঘাটে বিপদসীমার ১৩ দশমিক ২৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুশিয়ারা নদীর পানি বিয়ানীবাজারের শেওলা পয়েন্টে বিপদসীমার ১২ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার, শেরপুরে প্রবাহিত হয়েছে বিপদসীমার ৮ দশমিক ৩৪ সেন্টিমিটার ও জকিগঞ্জের আমলশীদে বিপদসীমার ১৫ দশমিক ৪৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জৈন্তাপুরে সারী নদীর পানি বিপদসীমার ১১ দশমিক ৬১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ায় বিপদসীমার ১৪ দশমিক ৬৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে, নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ ও উৎমা এবং গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি ও জাফলং পাথর কোয়ারির সকল প্রকার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ফলে এসব পাথর কোয়ারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২ লক্ষাধিক মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন।
কোম্পানীগঞ্জের ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন জানান, বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদীর পানি বাড়ছে। ইতোমধ্যে ওই নদীর তীরবর্তী এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় অসহায় হয়ে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে অসংখ্য মানুষ।
উপজেলার ধলাই নদীর পাশাপাশি পিয়াইন নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে উপজেলার সবকটি হাওর এখন পানিতে টুইটুম্বুর অবস্থা। তলিয়ে গেছে গ্রামাঞ্চলের অনেক সড়ক। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। তাদের অনেকে নিরাপদ আশ্রয়েও উঠছেন। বন্যাকবলিত এলাকায় ইতোমধ্যে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়ায় উপজেলার ৬০টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
এব্যাপারে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিজেন ব্যানার্জী বলেন, বন্যাকবলিত কিছু এলাকা পরিদর্শন করেছি। উপজেলার সকল আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। বন্যা মোকাবেলায় উপজেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে। গঠন করা হচ্ছে মেডিকেল টিমও।
এদিকে, গোয়াইনঘাট উপজেলায়ও বন্যা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনকারী বিভিন্ন সড়ক প্লাবিত হয়েছে। ফলে অনেক সড়কে যানবাহন যাতায়ত করতে পারছে না। বন্যার কারণে উপজেলার জাফলং ও বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারিতে সবধরণের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ইতোমধ্যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে উপজেলার ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানসহ সকল কার্যক্রম।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বজিত কুমার পাল বলেন, উপজেলার নদনদীর পানি এখনো বাড়ছে। তবে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে মোকাবেলা করে দ্রুত রিপোর্ট প্রদানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী ত্রাণসহ প্রয়োজনীয় সবধরনের সহায়তা প্রদান করা হবে।
সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি:
আমাদের সুনামগঞ্জে প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। জেলার তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ, দোয়ারাবাজার, ছাতকও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলাসহ বিভিন্ন স্থানে বন্যা পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। এসব উপজেলায় ৫০টি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৯২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি ওঠায় পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক জানান, সুরমা নদীর পানি শুক্রবার বিকেল ৩টায় বিপদ সীমার ৯৭ সে.মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বৃষ্টি এবং পাহাড়ী ঢল অব্যাহত থাকায় দ্রুত পানি বাড়ছে। ২৪ ঘণ্টায় ১৬৩ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামি ৭২ ঘণ্টা ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসমিন রুমা জানান, উপজেলার ১০টি স্কুলে বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। গৌরারং ইউনিয়নের বন্যার্তদের জন্য আড়াই টন চাল বরাদ্দ হয়েছে। তবে ভারী বর্ষণের কারণে বন্যার্তদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল পৌঁছাতে সমস্যা হচ্ছে। তিনি জানান, সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে বিশ্বম্ভরপুর-তাহিরপুরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ওই সড়কের আনোয়ারপুর, শক্তিয়ারখলা, লালপুর, চালবন্ধ এলাকাসহ কয়েকটি স্থান প্লাবিত হয়েছে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সমীর বিশ্বাস জানান, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পলাশ ইউনিয়ন, ফতেহপুর, সলুকাবাদ ও বাদাঘাট দক্ষিণ ইউনিয়নে কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। উপজেলার রঙ্গারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সাতগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় এবং ফতেপুরের হাজী মজিদ উল্লা উচ্চ বিদ্যালয়ে বন্যার্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। অন্যান্য এলাকার পানিবন্দি মানুষের জন্য বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তত রাখা হয়েছে।
দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষীপুর, সুরমা, ভোগলা, বাংলাবাজার, নরসিংহপুর এবং দোয়ারা সদর ইউনিয়নসহ পুরো উপজেলা বানের জলে মানুষ বন্দি অবস্থায় রয়েছেন। দোয়ারাবাজার-ছাতক উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়কের বিভিন্ন স্থান ডুবে যাওয়ায় এ সড়ক দিয়ে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সড়কের মাঝেরগাঁও, মংলারগাঁও ও নৈনগাঁও এলাকায় রয়েছে হাটু থেকে কোমর সমান পানি।
জামালগঞ্জ উপজেলা সদরের সঙ্গে জেলা সদরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এ উপজেলার সুনামগঞ্জ-সাচনা সড়কের নিয়ামতপুর, ইচ্ছারচর, বেরাজালী, সেলমস্তপুর ও কলাইয়া অংশে হাটু থেকে কোমর সমান পানি রয়েছে। উপজেলার আরেক সড়ক সুনামগঞ্জ-জয়নগর-জামালগঞ্জ সড়কের জয়নগর পার্শ্ববর্তী অংশে, রূপাবলি এবং ধনপুর অংশও প্লাবিত হয়েছে।
এব্যাপারে আলাপকালে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, জেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। তাছাড়া প্রস্তুত রাখা হয়েছে শুকনো খাবারও।