জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এখনো পিছিয়ে সিলেট
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ জুলাই ২০১৯, ৩:৪৪ অপরাহ্ণ
ইউনুছ চৌধুরী:
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এখনো পিছিয়ে রয়েছে সিলেট অঞ্চল। সিলেটে প্রজনন হার বা নারী প্রতি সন্তান গ্রহণের হার ২ দশমিক ৬ জন। যেখানে জাতীয়ভাবে সারাদেশে এই হার ২ দশমিক ৩ জন। অপরদিকে, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহীতার হার দেশের গড় হারের তুলনায় কম। সারা দেশে যেখানে এই হার ৬২ ভাগ। সেখানে সিলেটে এই হার ৫৫ ভাগ। যদিও দুই ক্ষেত্রেই ধারাবাহিকভাবে উন্নতি হচ্ছে। এদিকে, জনবল সংকট নিয়ে চলছে সিলেট পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার ৭৩ দশমিক ৬৩ ভাগ পদই শূন্য। এছাড়া অন্য পদগুলোতেও ব্যাপক কর্মকর্তার পদ শূন্য রয়েছে।
সিলেটে পূর্ব থেকে সারা দেশের মধ্যে জন্ম হার বেশি এবং পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহীতার হার কম ছিল। বর্তমানে তা জাতীয় হারের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উভয় ক্ষেত্রে জাতীয় হার অর্জিত হবে বলে প্রত্যাশার কথা জানিয়েছে সিলেট পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ।
সিলেট বিভাগীয় পরিবার পরিকল্পনা অফিস সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সিলেটে প্রজনন হার বা নারী প্রতি সন্তান গ্রহণের হার সব সময়ই বেশি ছিল। ১৯৭৫ সালে সিলেটে এই হার ছিল ৭ জন। তখন সারাদেশে এই হার ছিল ৬ জন। অর্থাৎ সিলেটে প্রতি পরিবারে গড়ে ৭জন করে সন্তান ছিল। ২০০৭ সালে সেই হার কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৭ জন, ২০১১ সালে ৩ দশমিক ১ জন। ২০১৪ সালে ২ দশমিক ৯ জন এবং ২০১৮ সালে সেই হার নেমে এসেছে ২দশমিক ৬ জনে। অপরদিকে, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহীতার পরিবার ছিল ২০০৭ সালে ৩১ দশমিক ৫ ভাগ, ২০১১ সালে ৪৪ দশমিক ৮ ভাগ, ২০১৪ সালে ৪৭ দশমিক ৮ ভাগ এবং ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ ভাগ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আগামী ২০২২ সালের মধ্যে সিলেটে নারী প্রতি সন্তান গ্রহণের হার ২ এ নামিয়ে আনা এবং পরিবার পরিকল্পনা গ্রহীতার হার ৬০ এ উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে তারা কাজ করছেন। পরবর্তিতে সেই হার ধরে রাখা তাদের কাজ।
এদিকে, মাঠ পর্যায়ে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সহকারী উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জানান, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মাঠকর্মীরা মানুষের ঘরে ঘরে যাচ্ছেন। বুঝাচ্ছেন মা ও শিশুর স্বাস্থ্য এবং শিশুর ভবিষ্যতের বিষয়ে। শুধু শিশু জন্মদানই নয় তার স্বাভাবিক বেড়ে উঠা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নত পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যার ৪ বা ৫টি সন্তান হয়ে গেছে তাকে স্থানীয় পদ্ধতি নেয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে বলেন, এক সময় এ বিষয়ে কাজ করতে অনেক বেগ পেতে হতো। সেসময় পিতামাতা শুধু সন্তানের আহারের বিষয়টি চিন্তা করতেন। এখন সন্তানের লেখাপড়া এবং স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়। ফলে নিজেরাই এখন অধিক সন্তান না নেয়ার বিষয়ে নিজে থেকে আলোচনা করেন। তবে অনেকের মধ্যে এই বিষয়ে এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। বাধ্যতামূলক শিক্ষা বা টিকাদানের মতো বিষয়টি এখনো জনপ্রিয় হয়নি।
‘এক সময় পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে কথা বলতে গেলে মানুষ অন্য চোখে দেখতো, এখন সহযোগিতা করে। অনেকে বাড়িতে ডেকে নেয়।’ বললেন সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাঁক ইউনিয়নের প্রত্যন্ত পাকনার হাওরপারের মাঠকর্মী রিতা রানী সরকার। তিনি জানান, আমারা পরিবারগুলোকে বুঝাই মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পরিবারের সমৃদ্ধির জন্য পরিবার পরিকল্পনা প্রত্যেকের ও প্রত্যেক পরিবারের একটি স্বাভাবিক কাজ। আপনার এবং আপনার সন্তানের কল্যাণে সরকার এসব সেবা বিনামূল্যে দিচ্ছে। তিনি বলেন, পরিবারের মহিলাদের সাথে কথা বলি। যাদের ২টি সন্তান থাকে তাদের জিজ্ঞাসা করি আর সন্তান নিবেন কিনা। জন্মনিয়ন্ত্রণের ৭টি পদ্ধতি সরকার থেকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেয়া হয়। তখন তারা তাদের পছন্দের বিষয়টি জানান। তবে সব জায়গায় সমান নয়। কোথাও কোথাও এখনো মানুষের ভুল ধারনা রয়েছে।
এদিকে, সিলেট বিভাগীয় পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে জনবল সংকট রয়েছে। সিলেট বিভাগে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসারের ৭৩ দশমিক ৬৮ ভাগ পদই শূন্য। যার মধ্যে সিলেটে ১২টি পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৩ জন। একইভাবে মৌলভীবাজারে ৭টি পদের বিপরীতে ২ জন, হবিগঞ্জে ৮টি পদের বিপরীতে ১ জন এবং সুনামগঞ্জে ১১টি পদের বিপরীতে মাত্র ৪ জন কর্মরত রয়েছেন। একইভাবে মেডিকেল অফিসার পদে সিলেটে ১৯টি পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ১৫জন, মৌলভীবাজারে ১২টির বিপরীতে ৬জন, হবিগঞ্জে ১৩টির বিপরীতে ১২জন এবং সুনামগঞ্জে ১৬টির বিপরীতে ১১ জন কর্মরত রয়েছেন। উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার পদে সিলেটে ৬০ জনের বিপরীতে রয়েছেন মাত্র ২৬জন, মৌলভীবাজারে ৪৩টি পদের বিপরীতে ২০জন, হবিগঞ্জে ৫২টি পদের বিপরীতে ১৫জন এবং সুনামগঞ্জে ৪২টি পদের বিপরীতে রয়েছেন মাত্র ৮ জন। অপরদিকে, ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ভিজিটর পদে সিলেটে ১১১ পদের বিপরীতে রয়েছেন ১০১জন, মৌলভীবাজারে ৭৭টি পদের বিপরীতে রয়েছেন ৫৩জন, হবিগঞ্জে ৯৬টির স্থানে ৭১ জন এবং সুনামগঞ্জে ৯৬টি পদের স্থানে কর্মরত রয়েছেন ৮৪জন। পরিবার পরিকল্পনা ইন্সপেক্টর পদে সিলেটে ১০০ পদের স্থানে রয়েছেন ৭৩জন, মৌলভীবাজারে ৬৯টির স্থানে ৫৬জন, হবিগঞ্জে ৭৮ জনের স্থানে ৭০ জন এবং সুনামগঞ্জে ৮২টির স্থানে ৭৭ জন কর্মরত রয়েছেন। ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার এ্যাসিসটেন্ট বা মাঠকর্মী পদে সিলেটে ৫০২টি পদের বিপরীতে আছেন ৪০৬জন, মৌলভীবাজারে ৩৪২ পদের স্থানে ২৪৪ জন, হবিগঞ্জে ৩৯৬টি পদের বিপরীতে ৩০৯ জন এবং সুনামগঞ্জে ৪১৯ পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৩০৯ জন।
অন্যদিকে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতো সিলেট বিভাগের ২০১৯ সালের প্রক্ষেপিত বর্তমান জনসংখ্যা ১ কোটি ১৯ লক্ষ ৯৩ হাজার ৫৩ জন। যা ২০১১ সালে ছিল ১ কোটি ৪৩ হাজার ১৬৯ জন। গত ৮ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে ১৯ লক্ষ ৪৯ হাজার ৮৮৪ জন। বর্তমান প্রক্ষেপিত সিলেট বিভাগের মোট জনসংখ্যার মধ্যে সিলেটে ৪৫ লক্ষ ১ হাজার ২২৫ জন, সুনামগঞ্জে ২৮ লক্ষ ৯৬ হাজার ১৫৭ জন, মৌলভীবাজারে ২২ লক্ষ ১ হাজার ৩১১ জন এবং হবিগঞ্জে জনসংখ্যা ২৩ লক্ষ ৯৪ হাজার ৩৬০ জন।
সিলেটে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সম্পর্কে পরিবার পরিকল্পনা সিলেট বিভাগীয় পরিচালক ও যুগ্ম সচিব কুতুব উদ্দিন বলেন, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সাথে শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য সেবা, সামাজিক নিরাপত্তা, গণসচেতনতাসহ সরকারের নানা প্রদক্ষেপের কারণে সিলেটে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেকটা কমে এসেছে। যদিও জাতীয় মাত্রা থেকে আমরা এখনো দশমিক ৩ ভাগ পিছনে রয়েছি। তিনি বলেন, ২০১৭ সাল থেকে ৫ বছর মেয়াদী ‘সেক্টর প্রোগ্রাম’ চলছে। যার লক্ষ্য ২০২২ সালের মধ্যে সিলেট অঞ্চলে টিএফআর বা নারী প্রতি সন্তান গ্রহণের হার ২ এ নামিয়ে আনা। একই সাথে সিপিআর বা পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহীতার হার ৬০ এ উন্নীত করা। সেই টার্গেট পুরনে কাজ চলছে। ইতিমধ্যে টার্গেটের অনেকটাই অর্জিত হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টার্গেটের পুরোটাই অর্জিত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। সেজন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
জনবল সংকটের বিষয়ে বলেন, জনবলের প্রকট সংকট রয়েছে। দ্রুত মাঠ পর্যায়ে শূন্য পদগুলো পূরণ না করলে কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। সুত্র-সিলেটের ডাক