ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ খ্যাত সিলেটে নকশার সাথে মিল নেই ভবনগুলোর
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জুলাই ২০১৯, ১১:০৫ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
সিলেটে ইমারত তৈরীতে সুনির্দিষ্ট নির্মাণবিধি থাকলেও মানা হচ্ছে না, আর মানানোরও কেউ নেই। ভবন নির্মাণের নকশার সঙ্গে মিল নেই অনেক ভবনেরই। অনুমোদিত নকশা একরকম থাকলেও,ভবন ওঠে আরেক রকম। এসব ভবনগুলোতে নেই যথাযথ অগ্নি নিরাপত্তার ব্যবস্থা। এভাবে একের পর এক গজিয়ে উঠছে নগরে ও শহরতলীতে ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে মানুষ চরম উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আর আতংকের মধ্যে বসবাস করছেন।
জানা গেছে, নগরায়নের নামে সিলেট নগরীতে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত বহুতল ভবন। ইট পাথরের নিস্প্রাণ নগরী যেন রূপ নিচ্ছে ঘিঞ্জি নগরে। একের পর এক মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে শপিংমল, অ্যাপার্টমেন্ট, হোটেল-মোটেলসহ অসংখ্য ভবন। অপরিকল্পিত ও নকশাবহিভূত ভাবে গড়ে ওঠা ভবনগুলোর বেশির ভাগই বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মাণ করা হচ্ছে। সিলেট সিটি কর্পোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে ভবন নির্মাণের জন্য নকশা অনুমোদন করা হলেও সয়েল টেস্ট ছাড়াই অপরিকল্পিতভাবে এসব ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। নকশা একরকম অনুমোদিত হলেও তৈরি করা হয় অন্য নকশায়। এছাড়া নগরে রয়েছে প্রায় শতাধিক ভবন দীর্ঘদিন ধরে জরাজীর্ণ ও বসবাসের অনুপযোগী। অনেক ভবণে ফাটল দেখা দিলেও ঝুঁকি নিয়েই মানুষ বসবাস করছেন। সিলেট গণপূর্ত বিভাগ কর্তৃক জেলা প্রশাসকের কার্যলয়ের একটি নিজস্ব ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা দিয়ে ভবনটি ব্যবহার না করার জন্য দেয়ালে সাইন বোর্ড টানায়। এরপরও সেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবণে চলছে কার্যক্রম। সাম্প্রতিককালের ঘন ঘন ভূমিকম্পের ঘটনা এ আতংক বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। এরপরও ভূমিকম্পে টনক নড়েছে প্রশাসনের।
ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ হিসাবে খ্যাত সিলেট। এখানে সময়ের সাথে পালা দিয়ে নগর, শহরতলী ও বিভিন্ন উপজেলাগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে বহুতল বিশিষ্ট উঁচু ভবন। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠায় সিলেটের মানুষ। বিশেষজ্ঞদের দাবি, প্রবাসী অধ্যুষিত বৃহত্তর সিলেটে পাকা ঘরবাড়ি নির্মাণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। এক জরিপে দেখা গেছে, সিলেট নগরীর ৭৪ শতাংশ ভবন নির্মাণে যথাযথ নিয়ম মানা হয়নি। বাড়ির নকশা, ফুটিং কন্ডিশন সঠিক নয়। বিল্ডিং কোডের নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। পাশাপাশি ভারসাম্যহীন বাড়ি, বহুমাত্রিক আকারের বাড়ি, ভুল নকশার ফাউন্ডেশনের ওপর নির্মিত বাড়ির সংখ্যাও নগরসহ সিলেটে বেশি।
সিলেট অঞ্চলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার এক জরিপে উল্লেখ করা হয়, এ অঞ্চলে শত শত পাকা ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ২৪ হাজার ভবনই ভূমিকম্পের জন্য ভয়াবহ। সিলেটে একশ’ থেকে দেড়শ’ বছরের প্রাচীন শতাধিক ভবন এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে। সিলেট নগরীতেই এ ধরনের স্থাপনা রয়েছে শতাধিক। এর মধ্যে অধিকাংশই ব্যবহৃত হচ্ছে সরকারী কাজে। যেগুলোকে অনেক আগেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নগর কর্তৃপক্ষ যেসব ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হচ্ছে- জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি ভবন, জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তার কার্যালয়, কাস্টমস অফিস, সিলেট সাবপোস্ট অফিসের ফরেন রেমিটেন্স শাখা ভবন ও সিটি মার্কেট। নগরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট হচ্ছে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত আলোচিত সুরমা মার্কেট। এ ভবনটির দুতলা অনুমোদন থাকলেও একেকটি ঘরের উপর পাঁচতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েেেছ। ফলে যে কোনো সময় এ মার্কেটটিতে বড় ধরণের বিপর্যয় ঘটতে পারে। সুরমা মার্কেটের ছাদ ও কার্নিশ ভেঙে পড়ে ইতোমধ্যে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়াও নগরের অভিজাত আবাসিক এলাকা হিসাবে খ্যাত শাহজালাল উপশহর। এখানে দিনে দিন বেঙের ছাতার মতো গড়ে উঠে বহুতল ভবন। এ এলাকায় অনেক ভবন জলাশয়ের উপর নির্মিত হয়েছে। এমনই একটি ভবন রয়েছে সি ব্লকের ৪৩ নাম্বার রোডে ৭১ নাম্বার বাসা। জলাশয়ের উপর পূথক তিনটি ব্লকে বহুলতল ভবন নির্মিত হয়। এ তিনটি ভবণে প্রায় পাঁচশত পরিবারের সদস্য সংখ্যা আড়াই হাজারের মতো। তারা অতি ঝুঁকিপূর্ণ এ ভবনটিতে ভয় নিয়েই বসবাস করছেন। গেলো ভূমিকম্পে এ তিন ভবন হেলে যায়। একটির সাথে অন্য লেগে গেছে। বিষয়টি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপ সিলেট ডিভিশন অফিসকে অবগত করলেও তারা নিশ্চুপ। এরকম অনেক ভবন সিলেট নগরের অলিগলিতে গড়ে উঠেছে।
এদিকে গণপূর্ত বিভাগ থেকে যেসকল ভবন ইতোমধ্যে ঝুকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- কালেক্টরেট ভবন-৩, সমবায় ব্যাংক ভবন, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় ভবন, খাদ্য অধিদফতর ভবন, কাস্টমস ও ভ্যাট অফিস ভবন, জেলা এসএ রেকর্ড অফিস। সিটি কর্পোরেশনের মালিকানাধীন হকার্স মার্কেট, সিটি সুপার মার্কেট। এ মার্কের কিছু অংশ ভেঙে দিলেও পুরো মার্কেটে চলছে ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা। রয়েছে, সুরমা মার্কেট, সবুজ বিপনী, মধুবন সুপার মার্কেট, রাজা ম্যানশন, মিতালী ম্যানশন, ফরিদ পাজা, মহাজন পট্টি, ইদ্রিস মার্কেটসহ অনেক বিল্ডিং।
এব্যাপারে আলাপকালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সিলেট অফিসের সহকারী পরিচালক বলেন, প্রতিটি বহুতল ভবনে ‘সেফটি প্ল্যান’ থাকা আবশ্যক। সিটি করপোরেশন থেকে নকশা অনুমোদনের আগে ভবন মালিককে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নিতে হয়। সিলেট ফায়ার সার্ভিসের কাছে নগরীর প্রায় ২শ’ বহুতল ভবনের তালিকা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব ভবনের প্রায় অর্ধেকই নির্মাণ হয়েছে ফায়ার সার্ভিস’র প্রাথমিক অনুমোদন না নিয়ে।
জাতীয় গৃহায়ন সিলেট ডিভিশনের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী বাদল কুমার মন্ডল বলেন, ভবন নির্মাণের নকশার সঙ্গে মিল নেই এমন ভবন মালিকের বিরোদ্দে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে হাউজিংয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরোদ্দে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে বলে তিনি জানান।
সুত্রঃ ড্রীম সিলেট