রহস্যঘেরা সুরমা মার্কেট : আলো-অন্ধকারের ইতিবৃত্ত
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:১৩:৪৪,অপরাহ্ন ০৭ জুলাই ২০১৯
চৌধুরী মুমতাজ আহমদ:
সুরমা নদীর উত্তর তীরে ক্বীন ব্রিজ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে পুরনো আমলের তিনতলা একটি বিল্ডিং। নদীর মতোই নদীর নামের এ মার্কেটটিও সিলেটের মানুষের কাছে অনেক পরিচিত। সুরমা মাকের্ট-সিলেটের মানুষের কাছে এক রহস্যঘেরা স্থান। আলো-আধাঁরিতে ঢাকা এ মার্কেটটি সম্পর্কে খুব একটা ইতিবাচক ধারণা নেই কারো কাছে। অনেকেই এ মার্কেটটিকে চেনেন, ‘জাল-জালিয়াতির আখড়া’ হিসেবে, নানা অনিয়ম আর অসামাজিক কাজের কেন্দ্র হিসেবেও বদনাম আছে এ মার্কেটের। তবে সুরমা মার্কেটের গল্প কিন্তু এমন ছিলো না। আজকের এ ‘অন্ধকারের মার্কেটটির’ সাথে অনেক মানুষের জীবন বদলের গল্প জড়িয়ে রয়েছে।
সুরমা মার্কেটের সুলুক সন্ধান করতে আমরা অনেকেরই দ্বারস্থ হয়েছিলাম। কেউই পরিস্কার করে কিছু বলতে পারেননি। প্রথমে যোগাযোগ হয় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক সচিব মো. মুহিবুর রহমানের সাথে। পৌর আমল থেকে সিটি কর্পোরেশন। দীর্ঘ সময় এখানে কর্মজীবন কেটেছে তার। ১৯৬৪ সালের ১ ডিসেম্বর সিলেট পৌরসভায় অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে যোগ দিয়ে ২০০৭ সালের ১৪ আগস্ট সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সচিব পদ থেকে অবসরে যান। তিনি স্মরণ করতে পারেন না কবে এ মার্কেট তৈরি হয়েছে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে বলেন, এ স্থানে পুরনো কাপড়ের দোকান ছিলো। তার ভাষ্য, ৭২-৭৪ সালে চার্চের যোগসাজশেই এখানে জায়গা বিকিকিনি হয়েছে। তিনি স্মরণ করেন বালাগঞ্জের ওমরপুরের ময়না মিয়া এ স্থানে প্রথম হোটেল নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে ৪৫ লাখ টাকায় তা বিক্রি করে দেন। মুহিবুর রহমান জানান, বিক্রির পারমিশন নেয়ার সময় পৌরসভায় চট্টগ্রাম থেকে চার্চের লোকজন এসেছিলেন।
অ্যাডভোকেট আ ফ ম কামাল মাঝে এক বছর বিরতি দিয়ে ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। কবে তৈরি হলো সুরমা মার্কেট- এ প্রশ্নের জবাব তিনিও দিতে পারেননি। তবে তিনি স্মরণ করেন ৬৯/৭০ সালে সুরমা মার্কেটে আওয়ামী লীগের অফিস ছিলো। আ ফ ম কামাল নিশ্চিত করেন ঐ সময় তিনি ন্যাপ (মোজাফ্ফর) সিলেট শহর কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন, সভাপতি ছিলেন রফিকুল ইসলাম। তিনি স্মৃতি ঘেঁটে বলেন, ‘১৯৬৯ সালে আবদুস সামাদ আজাদ যখন ন্যাপ থেকে থেকে আওয়ামী লীগে ফিরে যান তখন গুলজার আহমদকে সঙ্গে নিয়ে সুরমা মার্কেটে আওয়ামী লীগের অফিসে সামাদ আজাদকে সালাম করতে গিয়েছিলাম’
১৯৭৩ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত টানা দুই মেয়াদে ১০ বছর সিলেট পৌরসভার দায়িত্ব সামলেছেন বাবরুল হোসেন বাবুল। সুরমা মার্কেটের জন্ম কবে- এ প্রশ্নের জবাব মেলেনি তার কাছ থেকেও। তবে তিনি ‘ক্লু’ হিসেবে ধরিয়ে দেন যে ‘প্রবাসীর কথা’ গ্রন্থের লেখক নূরুল ইসলাম চৌধুরীই এর মূল কারিগর। বাবরুল হোসেন বাবুল তথ্য দেন যে, সিলেট অঞ্চলে ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসার বিকাশ ঘটে এই সুরমা মার্কেট থেকেই।
দু’ বছর আগে ফোনে যোগাযোগ হয় সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে থাকা নূরুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে। সুরমা মার্কেট সবার আগে ভাগ্য বদলে দিয়েছিলো ‘হাফ ব্যারিস্টার’ এই নূরুল ইসলামেরই। পাকিস্তান আমলের একদম শেষ দিকে তিনিই এ মার্কেটটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৫৬ সালের ৬ নভেম্বর ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডন যান সিলেটের দক্ষিণ সুরমার মোল্লারগাঁও ইউনিয়নের সদরখলার বাসিন্দা সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন ডা. মবশ্বির আলীর ছেলে নূরুল ইসলাম চৌধুরী। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে ১২০০ পাউন্ড দিয়ে লিংকন্স ইন কলেজে ইভিনিং শিফটে ভর্তি হন। তখন এক পাউন্ড ছিল ১৩ টাকার সমপরিমাণ। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ছিলেন কলেজে নূরুল ইসলামের সহপাঠী। নিজের খরচ যোগাতে সে সময় ব্রিটিশ অফিসে দাপ্তরিক চাকরি নেন নূরুল ইসলাম। ১৯৬৬ সালে পরীক্ষার যখন ৩ মাস বাকি ঠিক তখন দেশ থেকে মায়ের অসুস্থতার বার্তা নিয়ে টেলিগ্রাম পৌঁছে নূরুল ইসলামের কাছে। ফেব্রুয়ারি মাসে মাকে দেখতে দেশে আসেন তিনি। দেশে তখন আইয়ূব খানের শাসন। দেশে ফেরার সপ্তাহ খানেক পরই বিদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রমের অভিযোগে গ্রেফতার হন নূরুল ইসলাম। তার পাসপোর্টও জব্দ করে নেয় সরকার। মাসখানেক জেল খেটে বের হলেও পাসপোর্ট না থাকায় আর লন্ডন ফিরে যেতে পারেননি। ব্যারিস্টারি পড়া অসমাপ্তই থেকে যায়। তার নতুন পরিচয় হয় ‘হাফ ব্যারিস্টার’ হিসেবে।
বাবা তখন অবসরে। লন্ডনও যেতে পারছেন না নুরুল ইসলাম। তাই আয় রোজগারের পথ খুঁজছিলেন। তার বন্ধু হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্সের তৎকালীন রিজিওন্যাল ম্যানেজার দেওয়ান আহমদ কবির চৌধুরীই একটি পথ বাতলে দেন নূরুল ইসলামকে। বড় ভাই দেওয়ান মোয়াজ্জেম আহমদের কাছ থেকে খবর জেনে আহমদ কবির জানালেন বিশপ জেমস ডগলাস ব্লেয়ার আসছেন। এ সফরে তিনি সুরমা নদীর তীরে র্গিজার ৩ কেদার জায়গা থেকে কিছু জায়গা লিজও দেবেন। নূরুল ইসলামকে জায়গা লিজ নিয়ে মার্কেট করার বুদ্ধি দিলেন আহমদ কবির।
২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১২ ফুট প্রস্থ মাপের ২০টি দোকানের পরিকল্পনা করা হলো। মোয়াজ্জেম আহমদ বিশপের সাথে কথা বলে প্রতি প্লট ২০ হাজার টাকা স্থির করে দিলেন। নূরুল ইসলাম রওয়ানা হন ঢাকায়, জনসন রোডের সেন্ট থমাস ক্যাথিড্রালের উদ্দেশ্যে। ১৯৬৬ সালের আগস্টে ৫ হাজার টাকা বায়না দিয়ে ঢাকার মি. কেইনের সাথে চুক্তি হয় নূরুল ইসলামের। একমাস সময় নিয়ে সিলেট ফিরে আসেন তিনি। সিলেট এসে সদরখলা গ্রামের জলিল মিয়া মার্চেন্টের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ধার নেন। আরো টাকার প্রয়োজন। নূরুল ইসলাম গেলেন লালদীঘিরপার হাবিব ব্যাংকে। ম্যানেজার ইউসুফ চৌধুরী ছিলেন তার বন্ধু। নূরুল ইসলাম তাকে সব খুলে বললেন। তিনি নূরুল ইসলামকে নিয়ে গেলেন রিজিওনাল ম্যানেজারের কাছে। ইউসুফ চৌধুরীর সাথে রিজিওনাল ম্যানেজার সিকন্দর আহমদের কী যেনো কথা হলো। বিহারের বাসিন্দা সিকন্দর আহমদ বললেন, ‘ইয়ে সাব তোমারা দোস্ত হ্যায় তো হামারাবি দোস্ত হ্যায়, দে দো রুপাইয়া।’ একলাখ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন নূরুল ইসলাম। শুরু হলো সিলেটের প্রথম আধুনিক মার্কেট ‘সুরমা মার্কেট’ এর স্বপ্নযাত্রা।
যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের টার্গেট করেন নূরুল ইসলাম। তারা দেশে বিনিয়োগের সুযোগ পেয়ে দোকান কিনতে আগ্রহী হন। ২০টির পরিবর্তে ৫০টি দোকানের নকশা হয়। ২৫ হাজার করে প্রতিটি বিক্রি হয়। নূরুল ইসলাম নিজের নামের মার্কেটের ১ নং দোকানটি দিয়ে দেন বাবার মামাতো ভাই আলাউদ্দিন আহমদকে। ওখানেই গড়ে উঠে ‘লন্ডন ফটো ষ্টুডিও’। রাতারাতি ‘বড়লোক’ হয়ে উঠেন নূরুল ইসলাম। এ আয় থেকেই ৬৭ সালে বিয়ে করেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে গির্জাঘর রেখে আরও জায়গা লিজ নেন নূরুল ইসলাম, গড়ে উঠে নতুন ১৩৪টি দোকান। ১২ থেকে ১৫ হাজার করে বিক্রি হয় প্রতিটি। নূরুল ইসলামের সাফল্যে উৎসাহী হন অনেকেই। তার পার্শ্ববর্তী গ্রাম মন্দিরখলার তোরণ মিয়াসহ অনেকে এমনই পথ খুঁজেন। তাদের ‘তৎপরতা’য় এক সময় গির্জাও হারিয়ে যায় মার্কেটের নিচে। সুরমা মার্কেটের জায়গার গির্জার ছবিটি এখন কেবল ঝাপসা স্মৃতি হয়ে আছে কারো কারো চোখে।
তথ্য যাচাইয়ের জন্য দু বছর পর সম্প্রতি আবার যোগাযোগের চেষ্টা নূরুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে। তার স্ত্রী নার্গিস ইসলাম জানালেন স্মৃতি এলোমেলো হয়ে গেছে নূরুল ইসলামের। তবে ভরসা দেন নূরুল ইসলামের ৫২ বছরের জীবনসঙ্গী নার্গিস ইসলাম। বললেন তার জানা আছে সকল তথ্য। আমাদের তথ্যের সাথে মিলিয়ে নিলেন। বললেন, ঠিক আছে।
সুরমা মার্কেট। রকমারি মানুষের ভিড়ে সরগরম থাকে প্রতিদিন। সে ভিড়ের শুরু মার্কেটের জন্মলগ্ন থেকে। ষাটের দশকের শেষের দিকে যখন সিলেটে ‘লন্ডনযাত্রা’র হিড়িক, তখন সুরমা মার্কেটের ব্যস্ততার অন্ত ছিলো না। সিলেটে ট্র্যাভেলস এজেন্সি ব্যবসার পথ চিনিয়েছে এই সুরমা মার্কেটই। বিদেশযাত্রায় বৈধপথের পাশাপাশি চোরাপথেরও সন্ধান দিয়েছে সুরমা মার্কেট। ‘এভারেডি’ টর্চের পেছনের ছাপ দিয়ে নকল ভিসা তৈরি করে কতজনকে যুক্তরাজ্যের বাসিন্দা বানিয়েছে সুরমা মার্কেট তার হিসাব নেই। ব্রিটিশরা এখন সেয়ানা হয়েছে, সুরমা মার্কেটও কম সেয়ানা হয়নি। সুরমা মার্কেট থেকে এখন আর যুক্তরাজ্যের নকল ভিসা তৈরি করা সম্ভব নয়, তবে ‘নকল’ দিয়ে এখনও অনেকের ‘আসল’ স্বপ্নের ভিত গড়ে দেয় সুরমা মার্কেট। নকলের রমরমে ব্যবসা ফেঁদে প্রায়ই পত্রিকায় শিরোনামও হয় সুরমা মার্কেট। নকল সার্টিফিকেট, নকল সত্যায়ন, থিসিসের নকল পেপার, নকল রিপোর্টের সন্ধানে অনেকেই ভিড় করেন এ মার্কেটে। তারা জানেন এটা অন্যায়, কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে সে অন্যায়ের পথে পা বাড়ান তারা। অষ্টম শ্রেণী পাসের একটা নকল সার্টিফিকেট যোগাড় করতে পারলে হয়তো কোথাও অফিস সহায়কের একটা চাকরি জুটে যাবে। ছবি-সনদপত্র সত্যায়নের জন্য চাকরির আবেদনের মেয়াদ হয়তো পেরিয়ে যাবে না। অন্ধকারের সুরমা মার্কেট তাই কারো চোখে স্বপ্নের শেষ বাতিঘর হয়ে আছে। সুরমা মার্কেটে আরো কিছু গভীর অন্ধকার জমাও আছে, সমাজের কিছু লোভী মানুষ হোটেলে হোটেলে সেই অন্ধকার জমা করে রেখেছেন। মাঝে মাঝে পুলিশ হানা দেয়, সেই লোভী মানুষেরা ঠিকই আবার জমিয়ে তুলে তাদের আসর। এখানেও রহস্য হয়ে আছে সুরমা মার্কেট। সুত্র-একাত্তরের কথা।