জুয়াড়ি স্বামীর হাতে তিন নারী খুন : জুয়ার নেশায় বিলেতের বাঙালিরা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুলাই ২০১৯, ২:১৫ অপরাহ্ণ
সাঈম চৌধুরী, লন্ডন থেকে:
সাবিনা আক্তার, রোশনা বেগম ও আসমা বেগম। যুক্তরাজ্যে এই তিন বাঙালি নারীর মৃত্যু হয়েছে স্বামীর ছুরির আঘাতে। পৃথক পৃথক সময়ে তিনটি হত্যাকান্ডের পেছনে একটাই কারণ, স্বামীর জুয়া আসক্তি। জুয়ার অর্থ যোগাড় নিয়ে ঝগড়া কিংবা পারিবারিক সংঘাতের করুণ বলি হয়েছেন তারা তিনজন। এর এসব হত্যা ঘটনা থেকে বেরিয়ে এসেছে যুক্তরাজ্যে বাঙালি কমিউনিটির একটি অন্ধকার অধ্যায়।
বিলেতে বাঙালির একাংশ জুয়ার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ায় পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা যেমন ঘটছে তেমনি চুরি-ছিনতাই, মাদক লেনদেনের নেপথ্যেরও অন্যতম নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে কতিপয় বাঙালির জুয়ার নেশা। ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের জুয়ার নেশা যে সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে তার বিষয়ে সতর্ক বার্তা পাওয়া গেছে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেও। কয়েক বছর আগে সালফোর্ড ইউনির্ভাসিটির এক রিপোর্টে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়, ব্রিটেনে বাংলাদেশি, পাকিস্তানি ও ভারতীয় পুরুষদের জুয়ার আসক্তি যতটা ধারণা করা যায় তার চাইতেও বহুগুণ বেশি। এটাকে গোপন মহামারি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ঐ রিপোর্টে। ২০০৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত জরিপ পরিচালনা করে বাংলাদেশিসহ দক্ষিণ এশীয়দের জুয়ার আসক্তি সম্পর্কে সর্তক করে দেয় সালফর্ড এবং নেটকেন সোস্যাল রিসার্চ থিঙ্ক ট্যাংকের এই গবেষণা রিপোর্টটি। জুয়ার কারণে কমিউনিটিতে যে অপরাধপ্রবণ দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে এই বিষয়টিকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে আসমা বেগমের হত্যাকান্ডটি। এ বছরের ১১ জানুয়ারি পূর্ব লন্ডনে কেনিং টাউনে স্বামীর হাতে নিজ ঘরে খুন হন তিনি। বর্তমানে ‘ওল্ড বেইলি কোর্ট’ এ হত্যা মামলার শুনানি চলছে। শুনানিতে বেরিয়ে আসে হত্যার লোমহর্ষক তথ্য। আসমা বেগমের স্বামী ৪৭ বছর বয়সি জালাল উদ্দিন ছিলেন প্রবলভাবে জুয়ায় আসক্ত। এ নিয়ে স্ত্রীর সাথে তার মনোমালিন্য লেগে থাকতো সব সময়। জুয়া খেলায় অর্থ হারানো কিংবা পরিবার্রের জন্য বাড়তি চাপ দেওয়া নিয়ে স্ত্রী আসমা বেগমকে মারধরও করতেন জালাল উদ্দিন। মামলার শুনানিতে থেকে জানা যায়, যেদিন হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটে তার আগের দিনও স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করেন জালাল উদ্দিন। ঝগড়ার কারণ ছিলো যথারীতি জুয়া খেলতে গিয়ে অর্থ হারানো। পরদিনও একই বিষয় নিয়ে আবার ঝগড়া হয়। আর এরই রেশ ধরে ছুরি নিয়ে স্ত্রীকে উন্মত্ত আক্রমণ করেন জালাল। কোর্টকে জানানো হয়, কমপক্ষে ৫৮ বার ছুরির আঘাতে আসমা বেগমের দেহকে ক্ষতবিক্ষত করেন জালাল। এমনকি চিকিৎসকগণও গণনা করে বের করতে পারেননি আসলে আসমা বেগমকে কতবার ছুরিবিদ্ধ করা হয়েছে। মামলার শুনানি সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালে বিয়ে হয় জালাল উদ্দিন ও আসমা বেগমের। তারপর থেকে তারা পূর্ব লন্ডনে বাস করতেন। রেস্টুরেন্টের শেফ জালাল উদ্দিন এক সময় জুয়া খেলায় আসক্ত হয়ে পড়েন। ‘উইলিয়াম হিল’ এ নিয়মিত যাতায়াত করা জালাল উদ্দিনকে চিনতেন অন্যান্য জুয়াড়িরাও। তারা তাকে ‘অ্যাংরি ইন্ডিয়ান’ নামে ডাকতেন। জালাল উদ্দিন এতোটাই জুয়ায় আসক্ত ছিলেন যে, জুয়ার ঘরে এক বৈঠকে হাজার পাউন্ড পর্যন্ত বাজী ধরে হারতেন। অবশ্য শুনানি চলাকালে নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জালাল উদ্দিন। আগেই বলা হয়েছে জুয়ার কারণে এমন মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। ২০১২ সালের মে মাসে পূর্ব লন্ডনের ব্রমলি বাই বো রোডে ২৮ বছর বয়সি রোশনা বেগম খুন হন তার স্বামী শেখ ইসলামের হাতে। তাকে খুন করা হয় তাদের দুই বছরের বাচ্চার চোখের সামনে। পরিবারের অর্থ জুয়ায় বাজি ধরার কারণে ঝগড়ায় স্ত্রীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন শেখ ইসলাম। ইস্টহামের টেকওয়ে শপ বিক্রিসহ নানাভাবে প্রায় ৯০ হাজার পাউন্ড জুয়ায় হারান শেখ ইসলাম। এই মামলায় ‘ওল্ড বেইলি কোর্ট’ এ সাড়ে ১৪ বছরের কারাদন্ড হয় শেখ ইসলামের। এর আগে ২০০৯ সালে মানচেষ্টারে খুন হন আরেক গৃহবধূ সাবিনা আক্তার। মৃত্যুর আগে জুয়ারি স্বামীর বিরুদ্ধে দুই দুই বার পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছিলেন। আশঙ্কা করেছিলেন স্বামী তাকে হত্যা করতে পারেন। সাবিনার স্বামী ট্যাক্সি চালক মান্নান স্ত্রী সাবিনার বেনিফিটের অর্থও জুয়ার পেছনে ব্যয় করতেন। এ নিয়ে বিরোধে স্ত্রীকে হত্যা করে পালিয়ে বাংলাদেশ যাবার জন্য প্লেনের টিকেট কেটেও শেষ রক্ষা হয়নি মান্নানের। মানচেস্টার ক্রাউন কোর্টে এই মামলায় মান্নানকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করা হয়। সূত্র- একাত্তরের কথা।