শাহপরাণ এলাকায় দুই শাসকের লড়াই
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:০৫:১৯,অপরাহ্ন ০৩ জুলাই ২০১৯
ওয়েছ খছরু:
সিলেট জেলা যুবলীগের সভাপতি প্রার্থী ছিলেন এডভোকেট আফসর আহমদ। সভাপতি পদে তাকে নিয়ে সরব হয়ে উঠেছিলেন গ্রুপের নেতারা। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন তিনি। লড়বেন না সভাপতি পদে। এখন সাধারণ সম্পাদক হতে চান। আগেই এ পদে নিজের নাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন একই এলাকার আরেক সাবেক ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেন। সভাপতি পদ থেকে সাধারণ সম্পাদক হতে চাওয়ায় এখন নিজ এলাকার এক সময়ের প্রিয়জন জাহাঙ্গীরের মুখোমুখি হয়েছেন আফসর আহমদ।
তার এই ঘোষণায় যুবলীগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদকে ঘিরে জল্পনা দেখা দিয়েছে সিলেট শহরতলীর খাদিমপাড়া এলাকায়। গতকাল বিকাল থেকে ছড়াচ্ছে উত্তাপও। বিবদমান দুই বলয়ের দুই কর্মীর ওপর হামলা-পাল্টা হামলাকে কেন্দ্র উভয়পক্ষ শাহ্পরাণ এলাকায় শোডাউন করেছে। এ নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এডভোকেট আফসর আহমদ সিলেট শহরতলীর খাদিমপাড়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান। যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা হওয়ার কারণে এলাকায় তার শক্তিশালী বলয় রয়েছে। সম্প্রতি সময়ে পররাস্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত তিনি। একই এলাকা মেজরটিলা-ইসলামপুরের বাসিন্দা হচ্ছে জাহাঙ্গীর আলম। তিনি সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। আগে টিলাগড় গ্রুপের সিনিয়র নেতা ছিলেন তিনি। এখন মেজরটিলা-ইসলামপুরে নিজের গ্রুপ তৈরি করেছেন। এলাকার প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত জাহাঙ্গীর আলম। ছাত্রলীগের নেতা হওয়ার সুবাদে এলাকায় আগে থেকেই অবস্থান সুসংহত তার। আর চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে আফসর আহমদও শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছেন। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের পূর্বপর্যন্ত তাদের দুইজনের সম্পর্ক ভালো ছিলো। নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে তারা মুখোমুখি হয়েছিলেন। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হতে আফসরকে প্রথমে ছাড় দিতে চাননি জাহাঙ্গীর। দু’জনই প্রার্থী থাকায় এলাকার ভোটাররা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়েন। এ নিয়ে এলাকার মুরব্বী ও টিলাগড়ের নিয়ন্ত্রক সিনিয়র ভাইয়েরা হস্তক্ষেপ করেন। তাদের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত ইউনিয়ন নির্বাচনে আফসর আহমদকে ছাড় দেন জাহাঙ্গীর আলম। প্রকাশ্য বৈঠক করে নিজ থেকে সরে দাঁড়িয়ে সিলেট শহরঘেঁষা ওই ইউনিয়নে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে তিনি মাঠেও কাজ করেন। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আফসর ও জাহাঙ্গীরের মধ্যে মূলত এলাকার কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। জাহাঙ্গীরের গ্রুপের বাধার কারণে মেজরটিলা-ইসলামপুর এলাকায় এডভোকেট আফসর আহমদ নিজের অবস্থান সুসংহত করতে পারেননি। তবে পার্শ্ববর্তী শাহ্পরাণ এলাকায় তিনি নিজের গ্রুপের সুসংসহত অবস্থান গড়ে তোলেন তিনি। এলাকার কর্তৃত্ব ও গ্রুপিং রাজনীতির কারণে গত ৩-৪ বছর ধরে জাহাঙ্গীর ও আফসরের সম্পর্কে নানা সময় টানাপোড়েন দেখা দেয়। এ নিয়ে মেজরটিলা এলাকায় প্রায় সময়ই উত্তেজনা দেখা দেয়। তবে- মাঠের বিরোধ ততোটা চাঙ্গা ছিল না। কিন্তু যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদকে ঘিরেই দুইজনের বিরোধ এবার প্রকাশ্যে চলে এসেছে। দুইজনের অনুসারীরা খাদিমপাড়া এলাকায় মুখোমুখি হয়েছেন। এবারের মুখোমুখি হওয়ার কারণ হচ্ছে ‘গ্রুপিং রাজনীতি’। মাসখানেক আগে জাহাঙ্গীরের গ্রুপের কর্মী স্থানীয় গ্রীন হিলের ইন্টারের ছাত্র সেতুর উপর হামলা চালিয়েছিল আফসর গ্রুপের কর্মী রাসেল সহ কয়েকজন। মেজরটিলার চামেলীবাগ গলির মুখে তারা সেতুকে একা পেয়ে কোপায়। এতে সেতু গুরুতর আহত হন। এ ঘটনার পর মেজরটিলা বাজারে উত্তেজনাও দেখা দিয়েছিল। বিষয়টি সামাজিকভাবে সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত মামলা দায়ের করা হয়নি। পূর্বের ঘটনার নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে গত রোববার বেলা দুইটার দিকে রাসেলের ওপর হামলা চালায় জাহাঙ্গীর গ্রুপের কর্মীরা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- ইউনিয়ন অফিসে আসার সময় পরিষদের গলির মুখে ভাগ্নে রুহিতের নেতৃত্বে কয়েকজন যুবক তার ওপর এই হামলা চালায়। এ সময় তারা ছোড়া ও দেশীয় রামদা দিয়ে ইউনিয়নের অফিসের ভিতরে ঢুকে তার ওপর আক্রমণ করে। রাসেল ভয়ে ইউনিয়ন অফিসের ভিতরে ঢুকেও রক্ষা পায়নি। তার ওপর আক্রমণ করে তাকে রামদা দিয়ে তাকে কুপিয়ে তারা পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে রাসেল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে তাকে উদ্ধার করে ওসমানী হাসপাতালে পাঠানো হয়। হামলাকারীদের নেতৃত্বে থাকা রুহিত স্থানীয় জাহাঙ্গীর গ্রুপের নেতা। সে জাহাঙ্গীরের ভাগিনা হওয়ার কারণে ভাগ্নে রুহিত নামে এলাকায় পরিচিত। এ ঘটনায় খাদিমপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতা এডভোকেট আফসর আহমদ জানিয়েছেন- রাসেল আহমদের ওপর হামলায় জড়িত রুহিত তার ভাইয়েরা এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসী। তাদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে। এসব মামলায় পুলিশ তাদের অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, এরা যাদের প্রশ্রয়ে এলাকায় এ রকম একটি নির্মম হামলা সহ মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত সেইসব গডফাদারকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। এদিকে- রাসেলের ওপর হামলার ঘটনায় গতকাল বিকালে শাহ্পরান এলাকায় বিক্ষোভ করেছে আফসর আহমদের অনুসারীরা। তারা রাসেলের উপর হামলাকারী ও তাদের গডফাদারকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন। উপজেলা গেইটে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- ফখরুল ইসলাম দুলু, বদরুল ইসলাম, কামেল খলিল চৌধুরী, বাবুল আহমদ, সাহেদ আহমদ আনু, সোহেল আহমদ, ফরিদ মিয়া ও লিটন প্রমুখ। আফসর গ্রুপের কর্মীরা জানিয়েছেন- সমাবেশ শেষ করে তারা ইউনয়ন অফিসে জড়ো হলে সেখানে তাদের উপর জাহাঙ্গীর বলয়ের নেতারা হামলা চালিয়েছে। এদিকে- সাবেক ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন- তিনি ঘটনার কিছুই জানেন না। জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদ পদে প্রার্থী হওয়ার কারণে তাকে বিতর্কিত করতে খাদিমপাড়ায় এসব করা হচ্ছে। তিনি বলেন- আফসর আহমদকে আমি চেয়ারম্যান পদে ছাড় দিয়েছি। আর এই ছাড় দেওয়ার প্রতিদান তিনি নগ্নভাবে দিতে চাচ্ছেন। এটা কাম্য নয়। খাদিমপাড়ার মানুষ তাকে ও তার পরিবারকে ভালোভাবেই চেনে। হামলা পাল্টা হামলা নিয়ে রাজনীতি করে এলাকার শান্ত পরিবেশকে বিনষ্ট না করতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। এদিকে- সন্ধ্যার একটু আগে শাহ্পরান গেইট এলাকায় জাহাঙ্গীর বলয়ের কর্মীরা বিক্ষোভ করেছে। ওই বিক্ষোভ থেকে তারা সেতুর ওপর হামলাকারী ও তাদের গডফাদারকে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়।
এদিকে সন্ধ্যায় খাদিমপাড়া এলাকায় জাহাঙ্গীর গ্রুপ ও আফসর গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এসময় উভয়পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে।
সংঘর্ষ চলাকালে কয়েকটি দোকান, আটটি ট্রাক ও একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাঙচুর করা হয়। আগুন দেওয়া হয় পুলিশের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলসহ তিনটি মোটরসাইকেলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চার রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। এ সময় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একজনকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
রাতে গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় সিলেট-তামাবিল সড়ক অবরোধ করেন ট্রাক শ্রমিকরা। অবশ্য পুলিশের আশ্বাসে রাত পৌনে ১২টার দিকে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। সূত্র- মানবজমিন