‘লালে লাল শাজলাল’
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ জুলাই ২০১৯, ২:১৮ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ :
‘লালে লাল শাজলাল’- রোববার হাজারো কণ্ঠে সাধকপুরুষ হযরত শাহজালালের (রাহ.) জয়ধ্বনিতে মুখরিত হলো সিলেটের রাজপথ। সিলেট বিজয়ী বীর হযরত শাহজালালের (রহ.) ওরসকে কেন্দ্র করে প্রতিবারের মতো এবারও সম্পন্ন হয়েছে লাকড়ি ভাঙা উৎসব। এই উৎসবে সিলেট নগরের শাহজালাল মাজার এলাকা ও উত্তর দিকে বিমানবন্দর সড়ক দরগাগেইট ও আশপাশের এলাকা শাহজালালের অগণিত ভক্ত আর আশেকানদের পদভারে মুখর হয়ে ওঠে। আর এই উৎসবের মাধ্যমেই মূলত নগরকে জানান দেয়া হয় শাহজালালের ওরস সন্নিকটে। ওরসের ২৩ দিন আগে প্রতি বছরই অনুষ্ঠিত হয় লাকড়ি ভাঙা উৎসব। হযরত শাহজালালের ভক্ত আশেকানের কাছে এটি লাকড়ি ভাঙার মিছিল হিসেবে পরিচিত। হযরত শাহজালালের (রহ.) ওরসের ২৩ দিন আগে প্রতি বছর সিলেটের বিমানবন্দর সড়কে এই দৃশ্যের মঞ্চায়িত হয়।
ভক্ত আশেকানদের বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে রোববার বেলা ২টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত চলে লাকড়ি ভাঙা (লাকড়ি তোড়া) উৎসব। সকাল থেকে তারা জড়ো হন দরগাহ এলাকায়। জোহরের নামাজের পর দল বেঁধে রওয়ান শহরতলির বিমানবন্দর সড়কের লাগোয়া লাক্কাতুরা চা বাগানে চলে যান। সেখান থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে তারা মিছিল সহকারে ফিরে আসেন শাহজালাল (রহ.) মাজারে। মাজারের প্রথা অনুসারে সংগৃহিত এ লাকড়ি দিয়ে ওরসের সময় চুলায় প্রথম আগুন ধরানো হয়।
রোববার দেখা যায় শতাধিক ছোট-বড় ট্রাকে করে কয়েক হাজার ভক্ত লাকড়ি সংগ্রহ করতে যান। ট্রাকে সাজানো মঞ্চ থেকে ভেসে আসে অলি আউলিয়াদের নিয়ে রচিত গান- ‘আইছি সিলট, থাকমু সিলট, সিলট থাকমু শুইয়া/ যে মাটিতে ঘুমাইয়া আছইন তিন শ’ ষাট আউলিয়া’। পায়ে হেঁটে চলা জনতার ¯্রােত থেকে শ্লোগান উঠছে ‘লালে লাল, শা’জলাল (শাহজালাল)’। হাজার হাজার মানুষ লাল কাপড়ে সেজে কিংবা মাথায় বেঁধে মিছিল নিয়ে ছুটছেন শহরতলীর লাক্কাতুড়ার দিকে। সাধক পুরুষ হযরত শাহজালালের স্মরণে এ লালের শোভাযাত্রা। ট্রাক ছাড়াও অগণিত ভক্তরা পায়ে হেঁটেও লাকড়ি সংগ্রহ করতে যান।
ধারণা করা হয়, ৭ শ’ বছরেরও বেশি সময়কাল সিলেটের পথে এ রীতি চলে আসছে। লাকড়ি ভাঙা কেবলই এক প্রাচীন উৎসব নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে ইতিহাসও। হযরত শাহজালালের (রহ.) সিলেট বিজয়ের ইতিহাসের সাথে লাকড়িভাঙার সম্পর্ক জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। কথিত আছে, ১৩০৩ সালের এমনই এক দিনে সাধক পুরুষ হযরত শাহজালাল (রহ.) অত্যাচারী রাজা গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করে সিলেট জয় করেন। এরপর রান্নার প্রয়োজনে তিনি শহরতলীর লাক্কাতুড়া থেকে লাকড়ি বা কাঠ সংগ্রহ করেন। সেই বিজয়ের স্মারক হিসেবে হিজরি বর্ষপঞ্জির দশম মাস শাওয়ালের ২৬ তারিখ এ লাকড়ি ভাঙা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
লাকড়ি ভাঙার মিছিলে অংশ নিতে ঐ দিন সকাল থেকেই ভক্ত-আশেকানরা শাহজালালের (রহ.) দরগাহে সমবেত হতে থাকেন। জোহরের নামাজ শেষে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ভক্ত আশেকানরা খন্ড খন্ড মিছিল সহকারে লাকড়ি আনতে দরগাহ থেকে বিমানবন্দর সড়ক ধরে উত্তরে লাক্কাতুরার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
লাক্কাতুড়া নামটিও এসেছে এই লাকড়ি তোড়া থেকেই। লাক্কাতুরায় পৌঁছার পর সেখানে দোয়া ও শিরনি বিতরণের পর চা বাগান এলাকা থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করেন ভক্ত আশেকানরা। তারপর সে লাকড়ি নিয়ে মিছিল সহকারে আবার ছুটে চলেন শাহজালালের (রহ.) দরগাহ’তে। লাকড়ি নিয়ে যখন ভক্ত আশেকানরা ফিরে আসতে থাকেন মনে হয় যেনো সবুজ গাছের মিছিল হেঁটে হেঁটে নগরের পথে ছুটছে।
ওরসের সাথে লাকড়িভাঙার মূলত কোন সম্পর্ক না থাকলেও এ উৎসবটিকে হযরত শাহজালালের (রহ.) ওরসের প্রস্তুতি বিবেচিত হয় এখন। লাকড়িভাঙা উৎসবের সপ্তাহ তিনেক পরই (জিলকদ মাসের ১৯ তারিখ) শাহজালালের (রহ.) ওরস অনুষ্ঠিত হয়। লাকড়ি ভাঙা থেকে সংগৃহীত লাকড়ি দিয়েই সে ওরসে প্রথম আগুন ধরানো হয়।