জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সিলেটের প্রবীণ আ.লীগ নেতা আ ন ম শফিক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ এপ্রিল ২০১৯, ৮:১৮ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক :
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, বর্তমানে জাতীয় কমিটির সদস্য আ ন ম শফিকুল হক (৭০) জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন।
তিনি বেশ কিছুদিন ধরে কিডনী রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিলেটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে রয়েছেন। উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন আওয়ামী লীগের বর্ষিয়ান এ রাজনীতিবীদের। তাঁর উন্নত চিকিৎসার জন্য যতো টাকা প্রয়োজন তা নেই পরিবারের লোকজনের কাছে। ইতোমধ্যে প্রায় কোটি টাকা তাঁর চিকিৎসায় ব্যয় করেছে পরিবার। তাই আ ন ম শফিকের চিকিৎসার খরচ বহন করতে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে।
জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে পা রাখেন আ ন ম শফিকুল হক। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যূত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জনমত সংগঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর নিখোঁজ হওয়া ছোট ভাই এখনো ঘরে ফিরেননি।
মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছেন খালাতো ভাই ও মামাতো ভাইকে। সকল প্রতিকূলতাঁর মধ্যেও রাজনীতি থেকে এক পাও পিছু হটেননি প্রবীণ আওয়ামী লীগের এই নেতা। সিলেটের পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে যাদের সুনাম রয়েছে, তিনি তাদের অন্যতম একজন। এককালে সাংবাদিকতাও করেছেন।
ষাটের দশকে সাপ্তাহিক বাংলার বাণী পত্রিকায়, ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে সাপ্তাহিক খবর ও দৈনিক খবরে সিলেট বিভাগীয় প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে কাজ করেছেন। খন্দকার মোশতাক, জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার অপশাসনবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ২০০৬ সালে ১/১১ এর সময় কৌশলে সেনাসমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ার পাশাপাশি আন্দোলন চালিয়ে যান। ১৯৭৫ সালের কালরাতের পরবর্তী সময়ে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তবে নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়। ১৯৮৭ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করার কারণে দীর্ঘদিন কারাবরণ করেন।
পরিবার সূত্রে আরো জানা গেছে, আ ন ম শফিকুল হক ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির করে আসছেন। পর্যায়ক্রমে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে স্থান পেয়েছেন। ১৯৬৫ সালে এমসি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পরই নাম লেখান ছাত্রলীগে। লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনীতিই চলছিলো সমানতালে।
ছয় দফা আন্দোলনের সময়েও তিনি ছিলেন রাজনীতির মাঠে। ছিলেন স্বাধিকারের সকল আন্দোলনেই। হঠাৎ পরিবারে অসচ্ছলতা দেখা দিলে মাঝপথে পড়ালেখায় বিরতি ঘটে বিশ্বনাথ আওয়ামী লীগের কনিষ্ঠতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আ ন ম শফিকের। সংসারের চাকা গতিশীল রাখতে বাবার মতোই যুক্ত হন শিক্ষকতায়। বাবা মৌলভী তবারক আলী তখন সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দশপাইকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করলেও তিনি করেছেন পার্শ্ববর্তী মৌলভীগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
শিক্ষকতা করলেও রাজনীতির মাঠেও ছিলেন সরব। প্রতিটি রাজনৈতিক প্রোগ্রামে ছিলেন প্রথম সারিতে। ১৯৬৯ সালে অধিকার আদায়ের আন্দোলনেও ছিলেন রাজপথে প্রবীণ এ আওয়ামী লীগ নেতা। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরোটাই যুদ্ধের মাঠে কাটিয়েছেন আ ন ম শফিকুল হক। ৫ নং সেক্টরে থেকে সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তবে অস্ত্র হাতে নেননি।
নিজে যে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা নন সেটা স্পষ্টই সংবাদকর্মীদের কাছে স্বীকার করেন আ ন ম শফিক। তিন সেসময় জানিয়েছিলেন ‘চাইলেই সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট যোগাড় করে নিতে পারতাম। কিন্তু মিথ্যের প্রলেপ দিয়ে সত্যের মহিমাকে কালিমালিপ্ত করতে চাইনি আমি।’ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে আবার শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সিলেটের আওয়ামী লীগ নেতাঁরা তাকে শহরে টেনে নিতে চাইলেন।
নূরুল ইসলাম খান, শাহ মোদাব্বির আলী প্রায়ই তাকে বলতেন সিলেট শহরে এসে স্থায়ী হতে। কিন্তু তিনি গ্রামের মায়া, গ্রামের মানুষের মায়া কাটিয়ে শহরমুখী হতে পারেননি তখন। গ্রামের প্রতি এ ভালোবাসার প্রতিদান পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়নি। স্বাধীনতাঁর পরপরই বিশ্বনাথের ৫ নং দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনোনীত হন। মানুষের আরো কাছাকাছি আসার সুযোগ হয় তাঁর। সাধারণের জন্য আরো বেশি কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন তিনি।
১৯৭৭ সালে সিলেট শহরে ঠিকানা গাড়েন আ ন ম শফিকুল হক। অ্যাডভোকেট আবদুর রহীম, ডা. দেওয়ান নূরুল হোসেন চ লসহ স্থানীয় নেতাদের বারবার তাগাদার ফলেই জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অভিষিক্ত হন আ ন ম শফিকুল হক। ১৯৭৭ সালে নতুন করে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন হলে সিলেট আওয়ামী লীগের কমিটিতে সদস্য হিসেবে টেনে নেয়া হয় আ ন ম শফিককে।
সিলেটে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যাঁরা নিবেদিতপ্রাণ বলে পরিচিত ছিলেন। দলের দুর্দিনে যাঁরা ত্যাগীর ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হতেন তাদের মধ্যে আ ন ম শফিকুল হক অন্যতম। এরই ফল হিসেবে ১৯৮৬ সালে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান আবু নসর মোহাম্মদ (আ ন ম) শফিকুল হক। এরই মাঝে সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুর রহিমের মৃত্যু হলে সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আবু নসর ভার পান সভাপতির।
৯১ ও ৯৭ সালের সম্মেলনেও শীর্ষ পদে পুরনোরাই বহাল থাকেন। ১৬ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করায় ২০০২ সালের সম্মেলনে তাকে দেওয়া হয় সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব। পরবর্তীতে তাঁকে আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যও করা হয়।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য আ.ন.ম. শফিকুল হক। ১০ বছর সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ১৬ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তবে দলের প্রভাব কাটিয়ে অট্টালিকা বাড়ি ঘর করেনি। নিজের সততায় অটল ছিলেন তিনি। বর্তমানে আওয়ামী লীগের এ নেতার দুটি কিডনী নষ্ট হয়ে গেছে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। সপ্তাহে দুবার তার কিডনীতে ডায়ালাইসিস করাতে হয়।
মাসে অন্তত ১৫-২০ দিন হাসপাতালের বেডে কাটাতে হয়। তবে উন্নত চিকিৎসা করালে তিনি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠতে পারতেন বলে জানিয়েছে ডাক্তার। কিন্তু উন্নত চিকিৎসার ব্যয়ভার প্রচুর। ইতিমধ্যে পরিবারের লোকজন তাঁর চিকিৎসায় প্রায় কোটি টাকা খরচ করেছেন।
বর্তমানে তাঁর চিকিৎসা খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবার। প্রবীণ এ আওয়ামী লীগের এ নেতার চিকিৎসার জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতা চেয়ে পরিবার। বর্ষিয়ান এ আওয়ামী লীগ নেতার পাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাঁড়াবেন বলে প্রত্যাশা শফিকুল হকের পরিবারের লোকজন।