শিক্ষকরাও মানুষ ! তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:২১:১৯,অপরাহ্ন ২৮ এপ্রিল ২০১৯
আনোয়ার হোসেন আনা:
আজ যারা দেশের উচ্চাসনে বসে দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন তারা শিক্ষা জীবনে শিক্ষকের কাছ থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। শিক্ষকের হাতে ধরেই তৈরী হয়ে আসছে এদেশের একের পর এক প্রজন্ম। যারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূর্বার গতিতে। যাদের দ্বারা দেশ আজ উন্নত দেশের সারিতে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এমন একটা সময় ছিল, যখন শিক্ষকরা দেশের আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় মানুষের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিনা বেতনেই শিক্ষা দান করেছেন। অনেক শিক্ষক নিজেরাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে দেশের মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌছে দিয়েছেন। সময়ের ব্যবধানে দেশের আর্থিক অবস্থা উন্নয়ন হওয়ার পর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করা হয়। এতে একদিকে দেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্টির পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকরা উপকৃত হন।
কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো অনেকটা আগের মতোই রয়ে গেছে। তবে সরকার এমপিও ভূক্তির মাধ্যমে কর্মরত শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা প্রদান করা শুরু করে। প্রথমে খুব সামান্য টাকা পেতেন শিক্ষকরা। পর্যায়ক্রমে টাকার পরিমাণ বাড়তে থাকে। বর্তমানে সরকারিদের মতো শতভাগ বেতনের মূল অংশ পেয়ে আসছেন তারা। আর তা হয়েছে বর্তমান সরকারের মাধ্যমেই। কিন্তু সময় অনেক বদলেছে, বদলেছে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা। এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে শিক্ষকদের হাতে তৈরি দেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্টির মেধা ও শ্রম এবং বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন এবং জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়লেও ভাগ্য বদলায়নি দেশের বিপুল সংখ্যক বেসরকারি শিক্ষকদের। সমাজে শিক্ষকদের অধিকাংশই গরীব। যাদের নুন আনতে পানতা শেষ হয়ে যায়। শিক্ষকরা আশা করেছিলেন দেশের উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটবে কিন্তু তা ঘটেনি। যে পরিবার একজন শিক্ষকের উপর নির্ভশীল, সেই পরিবারই জানে তারা কত কষ্টে আছেন। প্রতিটি ঈদ কাটে শিক্ষকদের নিরানন্দে। ঈদের সময় শিক্ষকদের যে উৎসব ভাতা প্রদান করা হয় তা দিয়ে কখনোই নিজের এবং পরিবারের জন্য নতুন জামা কাপড় ক্রয় করা সম্ভব হয় না। যার কারণে ঈদের আনন্দ উপভোগের পরিবর্তে মনোকষ্টই উপভোগ করতে হয় একজন শিক্ষককে। তার সাথে কষ্টে পোড়েন শিক্ষক পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু যারা শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে শিক্ষকদের আর্থিক দৈন্যতার কথা ভাবতে সময় পান না তাদের কথা ভেবে সত্যিই মনটা খারাপ হয়ে যায়।
শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া দেয়া হয় মাত্র এক হাজার টাকা। কিন্তু আজকের দিনে যেকোন কলোনীতে একটি কক্ষের ভাড়া ১৫’শ থেকে ২ হাজার টাকা। তাহলে এই টাকা দিয়ে একজন শিক্ষককে তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই। যে শিক্ষকরা বাসা ভাড়া করে থাকেন তারা বুঝেন জীবন যাপন কাকে বলে, এবং কত কষ্ট।
শিক্ষকদের চিকিৎসা ভাতা মাত্র ৫শ’ টাকা। অথচ বর্তমান সময়ে একজন ডাক্তারের একবারের পরামর্শ ফি ৫-৭শ টাকা। অর্থাৎ এই টাকা দিয়ে পরিবারের কারো চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। এমন অবস্থা শিক্ষকদের বেঁচে থাকার উপায় কোথায়? কোন শিক্ষকদের বড় রোগ ব্যাধী হলে ভিক্ষার হাত মেলে ধরতে হয় মানুষের কাছে। যার ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। যে মানুষটা সমাজের আলোর দ্যোতি ছড়িয়ে তার এমন করুণ পরিণতি দেখে কী কারো কষ্ট লাগে না। লাগবেই বা কেন। যাদের অন্তরে আঘাত লাগলে শিক্ষকদের এমন অবস্থা হতনা তারাতো টাকা পয়সার অভাব নেই!
দীর্ঘ জীবন চাকুরী শেষে অবসরে যাওয়ার পর নিজের অবসর ও কল্যাণ তহবিলের টাকা বছরের পর বছর হেটে না পেয়েই অনেক শিক্ষক না খেয়ে বিনা বিনা চিকিৎসায় পরপাররে চলে চাওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে। তাছাড়া সরকারি বেতন ভাতার টাকাও সময় মতো পান না শিক্ষকরা। মাসের শুরুতে পাওয়ার কথা থাকলেও মাসের মধ্য ভাগে টাকা পেতে হয় শিক্ষকদের। সর্বশেষ সরকার শিক্ষকদের বৈশাখি ভাতা প্রদান করলেও নববর্ষের আগে সেই ভাতার টাকা শিক্ষকদের হাতে পৌছেনি। কিন্তু শিক্ষকদের এসব নিয়ে মাতা ঘামানোর কেউ নেই। কথা বলার কেউ নেই। শিক্ষকরা নিত্যান্তই যেন অবহেলার পাত্র। তাদের সাথে যে যেমন আচরণ করুক না কেন তাতে কারো যায় আসে না। তাদের যেন বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই!
এই দেশের, এই সমাজের লোকদের সন্তানদের শিক্ষা দানে ব্রত শিক্ষকরা। অথচ শিক্ষকদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। অনেক আন্দোলনের পর শিক্ষকদের বার্ষিক ৫ শতাংশ বেতন প্রবৃদ্ধির ঘোষণার পর শিক্ষকরা কিছুটা খুশি হন। কিন্তু সম্প্রতি বেতন থেকে ৪শতাংশ কেটে নেয়ার জারি করা প্রজ্ঞাপন শিক্ষকদের সেই আনন্দে বিষ মাখা কষ্ট এনে দিয়েছে। অর্থাৎ ৫ শতাংশ দিয়ে ৪ শতাংশ কেটে নিলে শিক্ষকরা বছরে একবার মূল বেতনের সাথে মাত্র ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পাবেন। এমনিতেই বেতন থেকে অবসর ও কল্যাণ ফান্ডের জন্য ৬ শতাংশ টাকা কর্তন করা হয়।
সমাজের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে আকুল-আবেদন জানাচ্ছি। আপনারা আর্থিক দৈন্যতায় জর্জরিত শিক্ষকদের পক্ষে নীতিগত কথা বলুন। আপনারা সবাই ঐক্যবদ্ধ ভাবে শিক্ষকদের পক্ষে নীতিগত কথা বললে শিক্ষকদের লাভ না হলেও ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই। অন্তত শিক্ষকরা মনে শান্তি পাবেন এই ভেবে যে, যাদের সন্তানদের আমরা আলোকিত করার চেষ্টা করছি তাদের অভিভাবকরা আমাদের আপনজন; তাই আমাদের হয়ে কথা বলছেন। দেশের জনগণের চাওয়া সরকার কখনো ফেলে দিবে না। সরকারের যারা নীতি নির্ধারক আছেন, আপনারাও তো একদিন শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। আপনাদেরও দায় আছে অনেক। কিন্তু আপনাদের কি করলেন শিক্ষকদের জন্য? প্লিজ নিজের বিবেকের সাথে একটু আলোচনা করুন। আপনার অবস্থান তৈরীর পেছনে আপনার বাবা-মায়ের মতো শিক্ষকের বিন্দু পরিমাণ অবদান আছে কি না। যদি বিবেক বলে আছে, তবে এগিয়ে আসুন শিক্ষকের নীতিগত দাবির পক্ষে কথা বলার জন্য। এগিয়ে আসুন শিক্ষকের নীতিগত দাবি গুলোর বাস্তবায়ন করার জন্য।
শিক্ষককে আর্থিক দৈন্যতায় রেখে দেশের আগামীর প্রজন্মকে সঠিক ভাবে তৈরী করা মোঠেও সম্ভব নয়। আগামীর প্রজন্মকে সঠিক ভাবে গড়ে তুলার জন্য শিক্ষকদের আর্থিক দৈন্যতার হাত থেকে মুক্তি দিতে কর্মরত সকল শিক্ষককের চাকুরী জাতীয় করণের জোর দাবি জানাচ্ছি।
আনোয়ার হোসেন আনা
শিক্ষক ও বার্তা সম্পাদক সুরমা নিউজ