রক্তাক্ত ‘সিলেট’
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ মার্চ ২০১৭, ১:১৪ পূর্বাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
হতবাক সিলেট। অবরুদ্ধ জনপদ। গেরিলা কায়দায় জঙ্গিদের অবস্থান। গুলি আর গ্রেনেডের শব্দে আতংকিত পুরো এলাকা। বাতাসে জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেড আর গুলির গন্ধ। জঙ্গি অভিযানের সাথে যোগ হয় লাশের মিছিল। একে একে যুক্ত হয় ৬টি লাশের খবর। জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারান দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ জন। ৬ লাশে রক্তাক্ত সিলেট। শোকে কাতর পুরো এলাকা। আহত হন র্যাব-পুলিশের সদস্যসহ ৪৪জন। শনিবার সন্ধ্যার বোমা হামলার পর একে একে মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হন সিলেটের কোর্ট ইন্সপেক্টর চৌধুরী আবু কায়সার, জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম, দক্ষিণ সুরমার বাসিন্দা ছাত্রলীগ নেতা ওয়াহিদুল ইসলাম অপু, ছাত্রলীগ নেতা ফাহিম আহমদ মাহদী, নগরীর দাঁড়িয়াপাড়ার বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম, অন্য আরেক জনের পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি কেউ। নিহতদের পরিবারে চলছে বুকফাটা আর্তনাদ। আর আহতরা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পাশে কাঁদছেন স্বজনরা। বোমা হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ ও র্যাব-৯ এর মেজর আজাদও। রাতেই লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়।
শোকার্তরা ছুটতে থাকেন ওসমানী হাসপাতালে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ি, তবুও ফিরে আসতে চান না তারা। রক্ত দেয়ার জন্য লাইন বেঁধে অপেক্ষা করতে থাকেন। ওসমানীতে সারারাতই চলতে থাকে শোকার্তদের মিছিল। শোকে আচ্ছন্ন সিলেটে রোববার দুপুরে অনুষ্ঠিত হয় দুই পুলিশ কর্মকর্তার জানাজা। সিলেট পুলিশ লাইন মাঠে অনুষ্ঠিত জানাজায় রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ শামিল হন।জানাজার নামাজে ইমামতি করেন মাওলানা সিরাজুল ইসলাম। এর আগে নিহত দুই কর্মকর্তার জন্য অশ্রুসজল কণ্ঠে দোয়া প্রার্থনা করেন নিহত আবু কায়সারের মামা আবদুল করিম চৌধুরী ও মনিরুল ইসলামের ভাই শামীম হোসেন। জানাজা শেষে দুই কর্মকর্তার প্রতি অন্তিম সম্মান জানানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। এরপর কফিনবন্দি করা হয় মরদেহগুলো। কফিনে জুড়ে দেয়া হয় নিহতদের নামলিপি। এরপর আবু কায়সারের মরদেহ নিয়ে পুলিশের গাড়ি ছুটে চলে সুনামগঞ্জের দিকে, আর মনিরুলের মরদেহবাহী পুলিশের গাড়ি ছুটে চলে নোয়াখালীর দিকে যেখানে নিহত দুই কর্মকর্তার স্বজনরা অপেক্ষায় তাদের প্রিয়জনকে শেষ বিদায় জানানোর জন্য।
জঙ্গি হামলায় নিহত কোর্ট ইন্সপেক্টর চৌধুরী আবু কায়সারের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ছৈলা গ্রামে। মরহুম অ্যাডভোকেট আসদ্দর চৌধুরীর ছেলে আবু কায়সার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষে ১৯৯৫ সালে পুলিশ বাহিনীতে সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে যোগদান করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন তিনি। তার স্ত্রী সায়রা চৌধুরী, কোনো সন্তান নেই তাদের। ৭ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে আবু কায়সার ছিলেন তৃতীয়। অন্যদিকে নোয়াখালী থেকে সিলেটে দায়িত্ব পালন করতে এসেছিলেন ইন্সপেক্টর মনিরুল ইসলাম। নোয়াখালী সদরের পূর্ব এওজবালিয়া গ্রামের মৃত নুরুল ইসলামের চার ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তানের মধ্যে মনিরুল দ্বিতীয়। ২০০৩ সালে সাব- ইন্সপেক্টর হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন তিনি। তার স্ত্রীর নাম পারভীন আক্তার। মোজাক্কেরুল ইসলাম ফারাবি নামে ১৫ মাস বয়সী ১ ছেলে সন্তানও রয়েছে তার।
নিহত ওয়াহিদুল ইসলাম অপু ও ফাহিম আহমদ মাহদী দুজনেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। মহানগর ছাত্রলীগ নেতা অপু নগরীর ঝালোপাড়ার মরহুম সিরাজুল ইসলাম আওলাদের একমাত্র ছেলে। নিহত ফাহিম আহমদ মাহদী ছাত্রলীগ দক্ষিণ সুরমা উপজেলা শাখার উপ-পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক।
বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়িতে জঙ্গি আস্তানা ঘিরে রেখেছিলো পুলিশ। শুক্রবার পুলিশের সঙ্গে যোগ হয় বিশেষ বাহিনী সোয়াত। পরে আসে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো টিম। শনিবার সকালে শুরু হয় জঙ্গিবিরোধী অভিযান ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। দিনভর চলে অভিযান, উদ্ধার করা হয় বাড়ির ভেতর আটকে পড়া বাসিন্দাদের। সেনাবাহিনীর অভিযান চলাকালীন সময়েই শনিবার সন্ধ্যায় পার্শ্ববর্তী পাঠানপাড়ায় প্রধান সড়কের পাশে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সড়কের ওই স্থানে ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহন ও সাধারণ মানুষকে আটকে দেয়া হয়েছিল। যানবাহন ও সাধারণ মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছিলেন। ব্যারিকেডের বাইরে উৎসুক মানুষজনও ভিড় করছিল। তখনই দুটো মোটরসাইকেলে চড়ে আসে তিন জন। তারা জনতার ভিড়ে ঢুকে যাওয়ার পর বিকট শব্দে ঘটে বিস্ফোরণ। সে হামলার শিকার হয়েই একে একে নিহত হন চার জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলটি ঘিরে রাখে। সেখানে তখন পড়েছিলো আরো একটি বোমা, কিছুক্ষণ পরই সেটার বিস্ফোরণ ঘটে। সে বোমার আঘাতেই নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশের ধারণা দ্বিতীয় বোমাটি ছিল টাইম বোমা। নিহতদের মধ্যে পাঁচজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলেও একজনের পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশের ধারণা অজ্ঞাতপরিচয় সে যুবকই হয়তো সেই তিন যুবকের একজন যারা বোমা বয়ে এনেছিলো। আহতদের মধ্যেও হামলাকারীরা থাকতে পারে বলেও ধারণা করছে পুলিশ। তাই আহত সকলেই রয়েছেন পুলিশের নজরদারিতেই।
শিববাড়ি এলাকার বাসিন্দা শহীদুল বলেন, ‘৩ দিন ধরে আতঙ্ক নিয়ে ঘরে দিন কাটাচ্ছি।আতংকিত হয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছি। কবে যেনো এ আতঙ্কের অবসান হবে। ’
জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহলে’ চালানো অপারেশন টোয়াইলাইটে দুই জঙ্গি নিহত হয়েছে এবং ভেতরে আরও জঙ্গি জীবিত আছে বলে আজ বিকেলে পাঠানবাড়ি মসজিদের কাছে সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান অভিযানে থাকা সেনা সদর দপ্তরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান। তিনি বলেন, এ ছাড়া সেখানে প্রচুর বিস্ফোরক আছে। এ কারণে অভিযান চলবে।