সিলেটে মৃত্যুপুরী থেকে বাঁচার আর্তনাদ ২৯টি পরিবারের
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ মার্চ ২০১৭, ১২:৫৯ পূর্বাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহল’ এর আশেপাশে চলছে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। ভিতরে রয়েছেন ভবনটির সাধারণ বাসিন্দাসহ জঙ্গিরা। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই- ঘরের ভেতরেই বন্দি প্রায় ২৯টি পরিবার। এসব পরিবারের সদস্য সংখ্যা শতাধিক। ছিল শিশু, নারী এমনকি প্রবীণরাও। ভোররাতে বোমা বিস্ফোরণের শব্দেই ঘুম ভাঙে তাদের। এরপর থেকে অন্তহীন টেনশনে সময় কাটান তারা। বাইরে থাকায় স্বজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তারা আর্তনাদ জানান – মৃত্যুপুরী থেকে বের করে নেয়ার। কিন্তু স্বজনদের কিছুই করার ছিল না। সময় যত বাড়তে থাকে ততই বাইরে থাকা স্বজনদের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। এদিকে- সকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই গোটা শিববাড়ি এলাকায়। সকাল ১০টার পর বন্ধ করে দেয়া হয় গ্যাস সংযোগও। ফলে ভেতরের বন্দিদশার দুর্ভোগ আরো বাড়ে। ঘরে থাকা শুকনো খাবারই ছিল তাদের ভরসা। আতিয়ার মহলের নিচ তলায় বসবাস করেন কমার্শিয়াল অডিটর অনিমেষ পালন। তিন বাচ্চা ও স্ত্রীকে নিয়ে তিনিও আটকা পড়েন ঘরের ভেতরে। তার পাশের ফ্লাটেই অবস্থান নিয়েছে জঙ্গিরা। সকালেই ওই ফ্ল্যাট থেকে তারা গ্রেনেডের শব্দ শুনেছে। গ্রেনেড বিস্ফোরণকালে গোটা ভবনই কেপে উঠে। এরপর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে রুমের একটি কক্ষে অবস্থান নেন অনিমেষ। ঘরে থাকা শিশুরা কান্না করছিল। তারাও ভয় পেয়ে গেছে। অনিমেষ মোবাইল ফোনে বাইরের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। দ্রুত তাদের ওখান থেকে বের করে নেয়ার অনুরোধ জানান তিনি। কিন্তু বাইরে দাঁড়ানো অনিমেষের স্বজনরা জানিয়েছেন- ‘পুলিশই ভয়ে বাসার ভেতরে ঢুকছে না। আমরা ঢুকি কীভাবে।’ ঢাকা দক্ষিণ কলেজের শিক্ষক নিরূপণ চক্রবর্তীর স্বজন উজ্জ্বল চক্রবর্তী বসবাস করেন ওই ভবনে। পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনি ভবনের ভেতরে অবরুদ্ধ। বিকাল ৩টা পর্যন্ত তিনি স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এবং তারা ভেতরে দমবন্ধ হওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছেন বলে জানান। দক্ষিণ সুরমার রেবতী রমন দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিহার রঞ্জন ভৌমিক ও তার পরিবার বসবাস করেন আতিয়ার মহলের দুই তলায়। তাদের ফ্ল্যাটের ঠিক নিচেই অবস্থান জঙ্গিদের। ওই বাসার ভেতরে সঙ্গে রয়েছেন তার স্ত্রী শিপ্রা তালুকদার ও আত্মীয় সজল কান্তি তালুকদার। সজল এই স্কুলের সহকারী শিক্ষকও। নিহারের স্বজন বাবলু জানিয়েছেন- সকালে গ্রেনেডের শব্দে তাদের ঘুম ভাঙে। এরপর থেকে তারা রুদ্ধশ্বাস অবস্থার মধ্য রয়েছেন। বিকাল পর্যন্ত চিড়া-মুড়ি ছাড়া তারা আর কিছুই খাননি। তিনি বলেন- ভেতর থেকে মোবাইল ফোনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। আমরা তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছি। তিনি বলেন- পুলিশও চাইছে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে ভেতরে আটকা থাকা পরিবারকে বের করে আনতে। এদিকে- আতিয়ার মহলের ঠিক পাশেই রয়েছে চার তলার আরো একটি ভবন। আতিয়ার ভবন ৫ম তলা। এখানে সর্বমোট ৩০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। সব ফ্ল্যাটই ভাড়া দেয়া। এই মহলে সরকারি কর্মকর্তারা ছাড়াও বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষকরা বসবাস করেন। অভিযান শুরুর পর থেকে আতিয়ার মহল থেকে কেউ বের হতে পারেননি। তবে- পাশের চারতলা ভবনে রয়েছে ১০টি ফ্ল্যাট। ওই ফ্ল্যাটগুলো থেকে পরিবারগুলোকে সকালেই সরিয়ে আনা হয়েছে। ওই পরিবারের সদস্যরা পাশের একটি স্কুলে অবস্থান নিয়েছেন। কেউ কেউ গেছেন স্বজনদের বাসায়। পাশের ভবন থেকে সকালের দিকে প্রায় ৩০ জন বাসিন্দাকে বের করে আনা হয় বলে জানিয়েছেন- সিলেট মহানগর পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) জেদান আল মুছা। তিনি বলেন- অভিযান পরিচালনা হবেই। তবে ক্ষয়ক্ষতি যাতে না হয় পুলিশ সেদিকেই লক্ষ্য রাখছে। এছাড়া- এ দুটি ভবন ছাড়াও পাশাপাশি আরো কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। এসব বাসার বাসিন্দাদেরও অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সকাল থেকে আশপাশের লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে চলে যান। একই সঙ্গে গোটা শিববাড়ি এলাকায়ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে যাননি। আর শিববাড়ি বাজারে কয়েকটি খাবারের দোকান ছাড়া অধিকাংশই দোকানপাটই ছিল বন্ধ।
শুক্রবার রাত পৌণে ৮টার দিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি টিম ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়। এর আগে শুক্রবার বিকেল থেকেই অবস্থান করছেন সোয়াত টিমের সদস্যরা। এছাড়া বোমা নিস্ক্রিয় টিমের সদস্যরাও রয়েছে ঘটনাস্থলে।
পাশাপাশি র্যাব, পুলিশ, ডিবি, সিটি এসবি, পিবিআইসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন সতর্ক অবস্থানে। তবে নিরাপত্তার কারণে কখন অভিযান শুরু করা হবে সে ব্যাপারে কোন তথ্য জানানো হয়নি। এর আগে গত শুক্রবার রাত ৩টা থেকে ওই বাড়ি ঘিরে রেখেছে পুলিশ। আতিয়া মহল নামের পাঁচতলা ওই ভবনের নীচতলার একটি ফ্ল্যাটে নারীসহ একাধিক জঙ্গি রয়েছে বলে ধারণা পুলিশের।