সিলেটে জাল কাগজে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার হিড়িক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১:০৯ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
মন্ত্রী-এমপির নাম ভাঙিয়ে সিলেটে জাল কাগজে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার হিড়িক পড়েছে। ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা পাওয়ার পর প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপির সুপারিশ নিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার বিশেষ সম্মানী পাওয়ার জন্য আরেক দফা আবেদন করেছেন অনেকেই। মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদায়ের জন্য নামের সঙ্গে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ খেতাব যোগ করছেন। ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে নানা প্রতিক্রিয়া। এক শ্রেণীর দালাল প্রতারক চক্রের মাধ্যমে প্রভাব খাটিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতাসংক্রান্ত সিলেট জেলা কমিটির সভার কার্যবিবরণী থেকে পাওয়া গেছে এসব চিত্র।
মন্ত্রণালয়ের নাম ভাঙিয়ে সুযোগ-সুবিধা নেয়ার ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘কেউ যদি বলে আমার সঙ্গে দেখা করে সার্টিফিকেট নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করা উচিত। টাউট-বাটপারদের সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য মন্ত্রী হইনি। যারা মন্ত্রণালয়ের নাম ভাঙিয়ে কথা বলছে, নিশ্চিত তারা প্রতারক চক্র। পত্রিকায় রিপোর্ট হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করব।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। সিলেট জেলা ইউনিটের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল জাল-জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক বরইকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রইছ আলী ও মোগলাবাজার থানার ভাঙ্গি গ্রামের রাজিউল ইসলাম তালুকদার রাজু সম্প্রতি বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি জানাজানি হলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ দক্ষিণ সুরমা ইউনিটে দেখা দেয় চরম অসন্তোষ। পরে দায়িত্বশীলরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ২০১৪ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা পাচ্ছেন রাজু। এরপরই ঘুম ভাঙে মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের। উপজেলা কমান্ডার কুটি মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা আলমাস মিয়া, জেলা প্রতিনিধি মুক্তিযোদ্ধা সুবল চন্দ্র পাল সংশ্লিষ্টদের কাছে অভিযোগ করেন।
এরপর গত এপ্রিলে বন্ধ করে দেয়া হয় সম্মানী ভাতা। তারপরও থেমে থাকেনি তাদের দৌরাত্ম্য। প্রভাব খাটিয়ে রইছ আলী ও রাজু চলতি মাস থেকে ফের সম্মানী ভাতা পাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এ ব্যাপারে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা কমান্ডার কুটি মিয়া এ প্রতিবেদককে বলেন, রইছ আলী ও রাজু মুক্তিযোদ্ধা নয়। তারা টাউট, চালবাজ। জাল কাগজপত্র সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধা সেজে কলংকিত করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের। এমনকি আমার সিল-স্বাক্ষরও জাল করেছে। তিনি এদের শাস্তির দাবি করেন। অভিযুক্ত রইছ আলী বলেন, আমাকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সার্টিফিকেট দিয়েছে। কার সঙ্গে কোথায় যুদ্ধ করেছেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, যুদ্ধ করিনি, সংগঠক ছিলাম।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অভিযুক্ত রাজু সম্প্রতি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্তি ও বিশেষ সম্মানী ভাতার আবেদন করেছেন। আবেদনে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদের সুপারিশসহ প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী ও প্রয়াত মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীরও সুপারিশ রয়েছে। এ ব্যাপারে রাজু বলেন, আমার ফরম পূরণ করার প্রয়োজন হয়নি। ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা আমার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি আর অন্য কোনো ভাতার আবেদন করিনি। বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের নওদার গ্রামের শুকুর আলী, খাজাঞ্চি ইউনিয়নের সুলেমান নগর গ্রামের গোলাম মস্তফা ও দিপবন্দ গ্রামের আবদুল খালিক আবেদন করেছেন।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গোলাম মস্তফা আমেরিকায় বসবাস করেন। শুকুর আলী ও আবদুল খালিক অনেক আগে মারা গেছেন। সূত্র জানায়, দক্ষিণ সুরমা সমাজসেবা অফিসে সম্প্রতি ২৩ জনের আবেদন যাচাই-বাছাইয়ে জন্য জমা হয়েছিল। যথাযথ না হওয়ায় তারা এগুলো ফেরত পাঠিয়েছেন। সম্মানী ভাতাসংক্রান্ত সিলেট জেলা কমিটি কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য নভেম্বরে ২৮ জনের নামের তালিকা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৫, সদর উপজেলা থেকে ৮, দক্ষিণ সুরমা থেকে ৭, জৈন্তাপুর থেকে ৬, গোলাপগঞ্জ থেকে ২, ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে ৩, জকিগঞ্জ থেকে ৪, কানাইঘাট উপজেলায় ২ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় ৩ জন আবেদন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রতিদিন নতুন আবেদন জমা পড়ছে। কোনো কোনো এলাকায় মন্ত্রী-এমপি তদবির করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছেন। এমনকি মাঠ পর্যায়ে থেকে প্রশাসনে প্রভাব খাটিয়ে তালিকায় অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতাসংক্রান্ত জেলা কমিটির সভাপতি সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, আমরা শুধু ভাতার ক্লিয়ারেন্স দিই। উপজেলা পর্যায়েও কমিটি রয়েছে। সমাজসেবা কর্মকর্তা সদস্য সচিব আছেন। বিস্তারিত তার কাছ থেকে জানা যাবে।
জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা নিবাস রঞ্জন দাশ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার ব্যাপারে বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গেজেট কিংবা সনদ দেয় সমাজসেবা অফিস শুধু তালিকা অনুযায়ী কাগজপত্র দেখে সম্মানী ভাতা দেয়। তবে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকায় মহানগর এলাকায় নতুন আবেদন করা ৯ জনের ব্যাপারে আপত্তি দেয়া হয়েছে।- যুগান্তর