বালাগঞ্জের মেয়ে রোকসানা বেগম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান কিক বক্সার
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:৫৭ অপরাহ্ণ
লন্ডন অফিস:
বালাগঞ্জের মেয়ে রোকসানা বেগম কিক বক্সিংয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান। এ বছর লন্ডনের দ্য রাউন্ড চাপেল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ওয়ার্ল্ড কিকবক্সিং এসোসিয়েশনের ৪৮ কেজি ওজন শ্রেণির বিশ্ব খেতাব জয়ের লড়াই। সুইডিশ চ্যাম্পিয়ান সুজানা স্যালমিজার্ভিকে হারিয়ে এ গৌরব অর্জন করেন এই ব্রিটিশ বাংলাদেশী । পাঁচ রাউন্ডের প্রতিটিতে হারিয়ে মুয়ে থাই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান খেতাব জিতে নিয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ বক্সিং কন্যা রুকসানা বেগম। ২০১০ সাল থেকে ব্রিটিশ মুয়ে থাই (৪৮-৫০ কেজি ওজন শ্রেণি) শিরোপা টানা ধরে রাখা রুকসানার এটাই প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান খেতাব জয়। প্রায় চার বছর ধরে ব্রিটিশ জাতীয় মুয়ে থাই দলের অধিনায়কের দ্বায়িত্ব পালন করা রুকসানা ২০১৩ এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালের মার্চে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান খেতাবের জন্য লড়েছিলেন।
লন্ডনের সেভেন কিংস এলাকায় ১৯৮৩ সালের ১৫ অক্টোবর জন্ম নেয়া রুকসানার বাংলাদেশে আদিবাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জে। আওলাদ আলী এবং মিনারা বেগম দম্পতির তিন ছেলে, দুই মেয়ের মধ্যে রুকসানা দ্বিতীয়। পেশায় কিকবক্সার হলেও রুকসানা পড়াশুনা করেছেন স্থাপত্য বিষয়ে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান খেতাব জয়ের লড়াইয়ে নামার একদিন আগে স্কাই নিউজকে দেয়া সাক্ষাতকারে রুকসানা বলেছিলেন, ‘এই লড়াই হয়তো কিকবক্সিং সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে দেয়ার কারণ হবে। কেননা, অনেকে আমার দিকে তাকিয়ে ভাবেন-ব্রিটিশ-বাংলাদেশি মুসলিম পরিবারের এতটুকুন একটা মেয়ে। আর আমার প্রশিক্ষক তো প্রায়ই মজা করে বলেন, আমি সংখ্যালঘুদের মধ্যেই সংখ্যালঘু।’
মনের মধ্যে চেপে থাকা জেদটা বুঝা গিয়েছিল ওই সাক্ষাৎকারেই। আর শনিবার (২৩ এপ্রিল) যখন রিংয়ে নামলেন তখন রীতিমত চোখে-মুখে যেন আগুণ ঝরছিলো রুকসানার। প্রতিপক্ষ ছিলেন সুইডিশ চ্যাম্পিয়ান সুজানা স্যালমিজার্ভি। পাঁচ রাউন্ডের প্রতিটিতে হারিয়ে মুয়ে থাই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান খেতাব জিতে নিয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ বক্সিং কন্যা রুকসানা বেগম। প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর একাগ্রতার বিজয়ে রচিত হলো আরেকটি নতুন ইতিহাস। ভুরু কুচকানো মানুষগুলোর কাছে পৌঁছে গেল রুকসানার বার্তা-‘বাংলাদেশি, মুসলিম পরিবার কিংবা শারীরিক গড়ন কোনো বিষয় নয়; মন-প্রাণ এক করে চাওয়াটাই বড় ব্যাপার।’ মুয়ে থাই উচ্চমাত্রার শারীরিক কসরতনির্ভর একটি খেলা, যা কিক বক্সিংয়েরই একটি ধরণ। থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী এই খেলায় হাত-পায়ের আক্রমণ চলে সমান তালে। কিল-ঘুষি-লাথি দিয়ে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার মধ্যেই বিজয়। ৩২ বছর বয়সী এই বক্সিং কন্যা বলেন, ‘সর্বোচ্চ শিরোপা জয়ের বিষয়টি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুই দফা পরাজয়ের অভিজ্ঞতা থেকে এবার নিজেকে বেশ পরিণত মনে হচ্ছিল। তাই মনোবলটাও ছিল প্রবল এবং হারের কথা মোটেও ভাবিনি।’
রুকসানার বক্সার হয়ে উঠা
বয়স তখন সতেরো কি আঠারো। পূর্ব লন্ডনের একটি ব্যায়ামাগারে ভর্তি হন রুকসানা। সেখানে শখের বশেই এক সময় বক্সিং প্রশিক্ষণ শুরু করেন। সুযোগ পান সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, খ্যাতনামা প্রশিক্ষক বিল জাডের কাছে থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী মুয়ে থাই শেখার। শখের খেলাই হয়ে উঠলো তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। রুকসানা বলেন, শুরুতে কয়েক বছর তিনি বক্সিং শেখার বিষয়টি গোপন রাখেন। ২০০৬ সালে ইউনির্ভাসিটি অব ওয়েস্টমিন্সটার থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর বিষয়টি পরিবারকে জানান। আক্রমণাত্মক এমন খেলার প্রতি আগ্রহের কথা শুনে বাবা-মা খুশি হতে পারেননি। ‘ধীরে ধীরে বাবা-মা বিষয়টিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। তারা আমাকে সমর্থন করেন, আমার জন্য মঙ্গল কমনা করেন। ‘ফাইট’-এ যাওয়ার আগে মা বুকে জড়িয়ে দোয়া করেন যাতে আমার কোনো ক্ষতি না হয়।’ তবে রুকসানা কখনো নিজের ‘ফাইট দেখাতে বাবা-মা কে নিয়ে যান না। এর কারণ হিসেবে বললেন, মারামারির ওই মুহূর্তগুলো বাবা-মা সহ্য করতে পারবেন না। তারা ভয় পাবেন।
স্বাস্থ্য রক্ষাই বড় কাজ
রুকসানার নিত্যদিনের কাজের মধ্যে স্বাস্থ্যরক্ষা করাই বড় চ্যালেঞ্জ। শরীরের ওজন রাখতে হয় ৪৮ থেকে ৫০ কেজির মধ্যে। এ জন্য শুধু নিয়ম মাফিক খাওয়া দাওয়াই নয়; চলে ঘামঝরা নানা কসরৎ। সপ্তাহে ছয়দিন দুই ঘন্টা করে চলে ব্যায়াম। আর ‘ফাইট’-এর জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সময় তাঁকে ওই ব্যায়াম করতে হয় দিনে দুই বার।
আরও যত ব্যস্ততা
রুকসানা কিকবক্সিংয়ের ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। সপ্তাহে প্রতি সোমবার তিনি পূর্ব লন্ডনের চ্যাডওয়েল হিথের ডেন জিম-এ স্কুল ছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে মুয়ে থাই প্রশিক্ষণ দেন। প্রতি রোববার চলে নারীদের প্রশিক্ষণ। তিনি ‘ফাইট ফর পিস’ নামে একটি চ্যারিটির মুয়ে থাই প্রশিক্ষক এবং স্পোটিং ইকুয়াল নামে আরেকটি চ্যারিটির অ্যাম্বাসেডর। চলতি বছরের শুরুর দিকে মুসলিম নারীদের জন্য তিনি নিজের করা নকশায় ‘স্পোর্টস হিজাব’ বাজারজাত শুরু করেছেন। এ সম্পর্কে রুকসানা বলেন, পেশাদার খেলাধুলার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা একটি বড় ব্যাপার। তাঁর বাজারজাত করা হিজাব মুসলিম নারীদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা মেনে খেলাধুলায় অংশ নিতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশের স্মৃতি
১৬ বছর বয়সে রুকসানা সর্বশেষ বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। দাদা দেশে বাড়ি বানিয়েছিলেন, সেই বাড়ি দেখতেই পরিবারের সাথে তাঁর যাওয়া। তখনকার স্মৃতি হাতড়ে রুকসানা বলেন, দাদা আমাকে একটা বাই-সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মানুষগুলো অসাধারণ। আত্মীয় এবং প্রতিবেশিদের কাছ থেকে যে আদর পেয়েছি- তা ভুলার নয়।