‘আব্বু আমি কলেজও যাইতাম, পরীক্ষা দিতাম’- খাদিজা
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ নভেম্বর ২০১৬, ১:০২ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
‘আব্বু আমি কলেজও যাইতাম, পরীক্ষা দিতাম, কতদিন কলেজও যাই না।’ এভাবেই একনাগাড়ে কথাগুলো বলেছেন ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলমের হামলায় আহত খাদিজা আক্তার নার্গিস। দীর্ঘ ৪০ দিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বেঁচে যাওয়া খাদিজা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন। আবার কলেজে যাবেন। এমন স্বপ্ন দেখছেন তার পরিবারও। রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের ১২ তলায় একটি কেবিনে চিকিৎসাধীন খাদিজা।
গত ৭ই নভেম্বর তার বাম হাত ও মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়। ব্যান্ডেজ করা হাত নিয়েই কেবিনের শয্যায় থাকা খাদিজা কথা বলেন, স্বাভাবিকভাবে খাবার খান। তবে তার হাতে আঘাত কেন জানতে চাইলে চুপ করে থাকেন। ভয়ানক সেই স্মৃতি তার মনে নেই। মনে পড়ে কলেজে আসা-যাওয়া, বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প করা স্মৃতিগুলো। কখনও কখনও খাদিজা ভুলে যান তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মনে করেন তিনি বাড়িতে আছেন। রান্না করতে চান। কেবিনে তার পাশে বসে থাকা মা মনোয়ারা বেগমের কাছে জানতে চান, ‘আম্মা কিতা পাক করতাম?’ কেমন আছেন জানতে চাইলে মাথা নাড়িয়ে জানান ভালো আছি। এভাবেই সময় কাটছে খাদিজার।
খাদিজার পিতা মাসুক মিয়া জানান, হামলার পর থেকে বাম হাত ও পা নাড়াতে পারতেন না খাদিজা। অবশ ছিল। শরীরের বাম দিক সচল হওয়ার পরই তার বাম হাতে অস্ত্রোপচার করা হয়। এখন বাম হাত ও পা নাড়াতে পারছেন। পরিবারের সবাইকে চিনতে পারছেন। কথা বলছেন। খাদিজা বারবার বাড়ি যেতে চান। কলেজে যেতে চান। আবার কখনও কখনও অসংলগ্ন কথা বলেন। হাসপাতালকেই বাড়ি ভাবেন। তবে প্রতিদিনই তার অগ্রগতি হচ্ছে বলে জানান মাসুক মিয়া। তিনি বলেন, অসংলগ্ন কথা সম্পর্কে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ধারালো অস্ত্রের আঘাত মাথার খুলি ভেদ করে ব্রেনে লেগেছে। যে কারণে দুবার তার মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। সর্বশেষ মাথায় করা ওই অস্ত্রোপচারকে ‘ক্রেনিওপ্লাস্টি’ বলা হয়। ধীরে ধীরে তা ঠিক হয়ে যাবে। এজন্য অন্তত আরো তিন মাস হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হতে পারে খাদিজাকে।
দীর্ঘদিন বাম হাত ও পা অবশ ছিল, যে কারণে ওই হাতে-পায়ে থেরাপি দেয়ার প্রয়োজনবোধ করছেন চিকিৎসকরা। দুই সপ্তাহ পরে হাতের ব্যান্ডেজ খোলার পর থেরাপি দেয়া হবে তাকে। নরম খাবারের পাশাপাশি ভাত, মাছ খাচ্ছেন খাদিজা। গতকাল নিজ হাতে তাকে খাইয়ে দিয়েছেন পিতা মাসুক মিয়া। মাসুক মিয়া জানান, ভাত, শিং মাছ, সবজি, দুধ খাওয়ানো হয়েছে দুপুরে। তার আগে সকালে নরম রুটি, সবজি ও পুডিং খেয়েছেন তিনি। মাসুক মিয়া বলেন, আল্লাহ মেয়েকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। চিকিৎসকরা আন্তরিকভাবে সেবা দিয়েছেন। মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠছে। আমরা এখন তাকে নিয়ে আগের মতোই স্বপ্ন দেখি। আমার মেয়ে অন্য আট-দশটা মেয়ের মতোই স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে।
খাদিজার চিকিৎসার ব্যাপারে মাসুক মিয়া বলেন, সরকারের মন্ত্রীরা এসেছিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাসপাতালের পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সরকারই চিকিৎসার ব্যয় বহন করছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মন্ত্রীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। একইভাবে অন্য যারা খাদিজাকে দেখতে গিয়েছিলেন, দোয়া করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মাসুক মিয়া বলেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, বিএনপি মহাসচিবসহ অনেকে আমার মেয়েকে দেখতে এসেছেন। মিডিয়া সরব ছিল। চিকিৎসকরা আন্তরিক। সবকিছু মিলিয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় মেয়েটি সুস্থ হয়ে উঠছে।
প্রবাসী মাসুক মিয়া বলেন, যখন খাদিজার ওপর হামলা হলো তখন আমি জেদ্দায়। দুপুরের খাবার খেতে বাসায় ছিলাম। এরমধ্যে দেশ থেকে ভাতিজি নাদিয়া ফোনে জানালো আমার মেয়েকে কে যেন মেরেছে। প্রবাসে থাকলে সারাক্ষণ মন পড়ে থাকে দেশে। আমার কলিজার টুকরা মেয়েকে মেরেছে শোনার পর বারবার দেশে বিভিন্ন জনের ফোনে কল দেই। বিস্তারিত কিছুই জানতে পারি না। অনেক পরে আমার ভাই জানালো, ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তার অবস্থা গুরুতর।
মাসুক মিয়া জানান, তারপরই মক্কা শরীফে চলে যান। সেখানে গিয়ে নফল নামাজ ও ওমরাহ হজ করেন। আল্লাহর কাছে মেয়ের জন্য দোয়া করেন। ৬ই অক্টোবর দেশে আসেন। মাসুক মিয়া বলেন, অনেক কষ্টের টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছি। তিনি বলেন, খাদিজার খুব ইচ্ছা লেখাপড়া করার। খাদিজার উৎসাহের কারণেই এসএসসি পাসের পর তাকে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি করা হয়। কলেজে আসা-যাওয়ার জন্য সিএনজি অটোরিকশা ও চালক ছিল। ওই অটোরিকশায় খাদিজার চাচা আব্দুল কদ্দুস তাকে আনা-নেয়া করতেন।
খাদিজার মা মনোয়ারা বেগম জানান, লেখাপড়া, ঘরের কাজ কোনো কিছুতেই পিছিয়ে ছিল না মেয়েটি। ও আমাদের একটা লক্ষ্মী মেয়ে। তাকে এভাবে কেউ মারতে পারে তা কল্পনা করা যায় না। মেয়ের হামলাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে মাসুক মিয়া বলেন, কঠোর শাস্তি হোক, যাতে আর কোনো মেয়ের এ অবস্থা না হয়। আর কোনো মা-বাবাকে এভাবে কাঁদতে না হয়।
গত ৩রা অক্টোবর বিকালে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে খাদিজা আক্তার নার্গিসের ওপর হামলা চালায় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলম। কলেজ ক্যাম্পাসের পুকুরপাড়ে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খাদিজাকে গুরুতর আহত করে সে। পরে হামলাকারী বদরুলকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাৎক্ষণিক তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে পরদিন ভোরে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। ওইদিন দুপুরে স্কয়ার হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা হয় তার। চিকিৎসকরা তখন বলেছিলেন, এ ধরনের রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শতকরা পাঁচ ভাগ। পরে তাকে ৯৬ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখেন চিকিৎসকরা। ৯৬ ঘণ্টা পর হাসপাতালের নিউরো সার্জন রেজাউস সাত্তার জানিয়েছিলেন, খাদিজাকে নিয়ে আশার আলো দেখছেন। পেইন দিলে রেসপন্স করছেন। চোখ খুলে তাকাচ্ছেন। ডান হাত ও ডান পা নাড়াচ্ছেন। তারপর চিকিৎসকদের সেবায় ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকেন খাদিজা। শুরু থেকে হাসপাতালের আইসিইউ’তে চিকিৎসাধীন ছিলেন খাদিজা। পরবর্তীতে অবস্থার উন্নতি হলে হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। ক্রমান্বয়ে আরো উন্নতি হওয়ায় পর গত ২৭শে অক্টোবর তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।