সিলেটে জমজমাট ভয়ঙ্কর তীর খেলা
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ নভেম্বর ২০১৬, ১:২৯ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরুঃ সিলেটে ফের জমজমাট হয়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর তীর খেলা। এর আগের তীর খেলার মাধ্যমে জুয়ার আসরের বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ ঘোষণা করেছিল মহানগর পুলিশ। এর অংশ হিসেবে গোয়েন্দা পুলিশের ব্লকরেইডও চলেছে। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক মাসে সিলেটে কম করে হলেও অর্ধশতাধিক জুয়ার আসর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আর এই অভিযানে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা কুড়িয়েছে সিলেট মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিট। কিন্তু জুয়ার আসর বন্ধ করা হলেও ফাঁড়ি ও গোয়েন্দা পুলিশের মাঠপর্যায়ের সদস্যদের কারণে তীর খেলা ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সিলেটে। নগরীর এমন কোনো এলাকা নেই যে, যেখানে শিলংয়ের তীর খেলা নিয়ে জুয়া হচ্ছে না। আর এসব আসরে কিছু কিছু পুলিশ সদস্যর অবাধে যাতায়াত রয়েছে। ‘তীর খেলা’ লটারি খেলা। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রচলন রয়েছে এ খেলার। কয়েক বছর ধরে সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে তীর খেলা শুরু হয়। এর মধ্যে ভোলাগঞ্জ, দয়ারবাজার, বিছনাকান্দি, পাদুয়া, জাফলং, মামার দোকান, তামাবিল, জৈন্তাপুর, কানাইঘাটসহ কয়েকটি এলাকায় এসব অবৈধ তীর খেলার প্রচলন ছিল। তীর খেলার নামে বাংলাদেশ থেকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছিল। পরবর্তী সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও পুলিশ ওই সব এলাকাগুলোতে তীর খেলার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। এরপরও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওই তীর খেলা চলছিল। সিলেট শহরে তীর খেলার তেমন প্রচলন ছিল না। কিন্তু গত এক বছর ধরে সিলেটেও তীর খেলা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে খেলাটি জনপ্রিয়। ১ টাকায় ৭০ টাকা পাওয়া যায়-এমন খেলায় ঝুকেছেন রিকশা চালক, সিএনজি অটোরিকশা চালক, ক্ষুদ্র দোকানি থেকে চাকরিজীবীরাও। এমনকি ক্ষুদ্র ঋণ নিয়েও সিলেটে তীর খেলায় অংশ নিচ্ছে লোকজন এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। সিলেটে জুয়ার পুরাতন আস্তানাগুলোকে কেন্দ্র করে তীর খেলা পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কারণে গেলো সেপ্টেম্বর থেকে সিলেট মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিটের সদস্যরা জুয়ার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে অভিযান শুরু করে। তাদের অভিযানে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা ও উত্তর সুরমার অর্ধশতাধিক জুয়ার আসর তছনছ করে দেয়া হয়। এসব জুয়ার আসর এখন বন্ধ। কিন্তু জুয়ার আসর বন্ধ করলেও সিলেট নগরীতে তীর খেলা বন্ধ করা যায়নি। সিলেট নগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকায়ই চলছে এ খেলা। আর এতে অংশ নিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে সিলেটে খেটে খাওয়া মানুষ। সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় তীর খেলা চলছে। পাশাপাশি উত্তর সুরমায়ও চলছে এ খেলা। গত দুই মাস ধরে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল এলাকায় এই খেলা এখন জনপ্রিয়। মেডিকেল রোডের তীর খেলা পরিচালনা করা হয় আবাসিক হোটেল শফিক রেস্টহাউজ থেকে। কাজলশাহ এলাকার সঞ্জু নামের এক যুবক ওই এলাকার নিয়ন্ত্রক। মেডিকেল রোডের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তীর খেলার কারণে সন্ধ্যার পর জমজমাট থাকে মেডিকেল রোড। প্রতিদিন ৫-৬ লাখ টাকা লেনদেন হয়। মেডিকেল রোডের রিকশা চালকসহ নিম্নবিত্ত পেশার মানুষ এই খেলায় জড়িয়ে পড়েছে। সঞ্জুর নেতৃত্বে হোটেলের ম্যানেজার কাদির মিয়া ও এলাকার হাবিব, বিকাশ, জাভেদ ও সুমন নামের ৫ জন হচ্ছে সিন্ডিকেটের সদস্য। এ ছাড়া কুয়ারপাড় এলাকার শাহজাহান ও শাপলার পিছনের অংশে জামাল ওরফে শাহজাহান নামের আরো দুই জন তীর খেলার নিয়ন্ত্রণ করছে। এ দুটি আস্তনায় প্রতিদিন ১০-১২ লাখ টাকার লেনদেন হয়। শেখঘাট এলাকায়ও রয়েছে আরো কয়েকজন। তারা কাজিরবাজার ব্রিজ এলাকা, দক্ষিণ অংশের মারকাজ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। নগরের রিকাবীবাজার, বাগবাড়ি, মদিনা মার্কেট, সুবিদবাজার এলাকায় পৃথক পৃথকভাবে নিয়ন্ত্রক রয়েছে। আর তীর খেলার সবচেয়ে বড় আসর বসে বাদামবাগিছা এলাকায়। ওই এলাকার স্থানীয়রা উৎসাহ নিয়ে তীর খেলায় অংশ নেন। পাশের লাক্কাতুড়াসহ কয়েকটি বাগানেও তীর খেলা হচ্ছে। নগরীর টিলাগড়, মেজরটিলা, উপশহর এলাকায় সম্প্রতি সময়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বন্দরবাজার এলাকায় কম হলেও ১০টি স্পটে তীর খেলা হচ্ছে বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন। এ কারণে সন্ধ্যার পর এসব এলাকায় লোক সমাগম বেড়ে যায়। মেডিকেল এলাকার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কয়েক দিন আগে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল নগরীর ঘাসিটুলা এলাকা অভিযান চালায়। সেখান থেকে তীর খেলায় জড়িত কয়েকজনকে আটক করে মেডিকেল এলাকার একটি হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নাস্তা খাওয়ার একপর্যায়ে আটককৃতদের হোটেলেই ছেড়ে দিয়ে পুলিশ চলে যায়। একই ভাবে কুয়ারপাড় এলাকায় অভিযান চালানো হয়েছিল। হাতেনাতে ওই এলাকার নিয়ন্ত্রককে আটক করা হলেও পরে তাকে ছেড়ে চলে আসে। পুলিশ আসার পর তীর খেলার নিয়ন্ত্রকের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়- ‘পুলিশ সব টাকা নিয়ে গেছে আজ আর খেলা হবে না’। সুতরাং পুলিশ অভিযান চালালেও তীর খেলার নিয়ন্ত্রকদের কোনো লোকসান গুনতে হয় না। দক্ষিণ সুরমার মারকাজ পয়েন্টে মিন্টু, তিতাস, পুরাতন রেলওয়ে এলাকার শিপলু, বঙ্গবীর রোডে কুমিল্লা বাস স্ট্যান্ড এলাকায় কয়েস, তালতলার আনা ম্যানশন, বালুচরের সাদেক, শান্তিবাগের সুলতান, আরামবাগে বাবুল, আলাল, দুর্গাবাড়ির আলমের নেতৃত্বে তীর খেলা চলছে। স্থানীয়রা জানিয়েছে, তালতলার একটি স্পটে কয়েক দিন আগে গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে আটক করে। পরে টাকার বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। লালদীঘির পাড়ে অভিযান চালিয়ে তীর খেলা সিন্ডিকেটের কয়েকজনকে আটক করলেও পুলিশ থানায় নেয়ার আগেই ছেড়ে দেয়। তবে, সিলেট মহানগর পুলিশের সিনিয়র এক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিলেট মহানগর পুলিশ তীর খেলার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এ কারণে নগরীর ঘাসিটুলাসহ কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এখন লুকিয়ে তীর খেলা পরিচালনা করছে কিছু লোক। তাদের গ্রেপ্তারেও অভিযান চলছে। এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) মো. রহমতুল্লাহ মানবজমিনকে জানিয়েছেন, তীর খেলার বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর। তিনি বলেন, তীর খেলা নির্মূল করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মানুষ সচেতন হলেই এই খেলা বন্ধ হবে।-মানবজমিন