অপরাধীরা বেপরোয়া : সিলেটে বেড়েই চলেছে বর্বরতা
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ অক্টোবর ২০১৬, ১:৫১ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
সিলেটে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমাবনতির দিকে যাচ্ছে। একই সাথে বেড়েই চলেছে বর্বরতা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণেই অপরাধী চক্র নানা ধরণের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারছে। এর দায় মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরই বর্তায়।
এত থানা-পুলিশ, বিশেষ সংস্থার এত লোকজনের কাজ কি? কোন এলাকায় কোন অপরাধী চক্র সক্রিয়, তার সব তথ্য তো তাদের নখদর্পণে থাকার কথা (!) খুন, হামলা, নির্যাতন, ছিনতাই, রাহাজানিসহ বিভিন্ন ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হলেও বিচার প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে নিতে এগুলো আর গতি পায় না। সব মিলিয়ে সিলেটে অপরাধ যেন অনেকটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে, তদন্তকারী কর্মকর্তা গাফিলতি, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চাপে পুলিশি কার্যক্রম চলে ধীরগতিতে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আইনি তৎপরতা কিংবা অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি না-হওয়ায় অপরাধীরাও হয়ে উঠছে বেপরোয়া। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পরিসংখ্যানে সাম্প্রতিক সময়ের বর্বরতার চিত্র আঁতকে উঠার মতো।
সিলেটে ঘটে যাওয়া একেকটি ঘটনা সারা দেশ এমনকি দেশের সীমানা ছাড়িয়েও তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। পারিবারিক কলহের জেরধরে গত ২৪ অক্টোবর সিলেটের ওসমানীনগরে রুজেল (১১) ও মামুন (৭) নামের দুই পুত্র সন্তানকে পরিকল্পিতভাবে খুন করে তাদের পিতা ছাতির আলী। শুধু রুজেল কিংবা মামুন নয় রাজন, সাঈদ, মামুন, শাকিল, তাজুল, নূরজাহান হত্যা, বাহুবলে চার শিশুকে মাটিচাপা আর খাদিজার চিত্র তার জ্বলন্ত উদাহরণ। এছাড়াও প্রতিনিয়িত বর্বরোচিত হামলার শিকার হচ্ছে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। সেই সাথে অপরাধীদের নির্মম নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছে না স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
সিলেটে কোতোয়ালি থানায় দায়েরকৃত হত্যা মামলার মধ্যে নগরীর রায়নগরের ব্যবসায়ী বিকল, জিন্দাবাজারের ব্যবসায়ী মামুন, শামীমাবাদে শ্রমিক ইসলাম হোসেন এবং বিমানবন্দর থানাধীন পাঠানটুলা এলাকায় নগরীর একটি বাসার দখল নিয়ে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় খুন হন স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা আব্দুল্লাহ অন্তর। আলোচিত এসব হত্যা মামলার দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই। এসব ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের পর পুলিশের দায়িত্ব যেন এখানেই শেষ (!) এখন পর্যন্ত আলোচিত এসব হত্যা মামলায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা দূরের কথা ঘটনার মূলহোতারা কোথায় আছে তাও জানা নেই পুলিশের।
এদিকে, ২৬ আগস্ট শুক্রবার সিলেটে ছাত্রলীগ নেতার ছুরিকাঘাতে নিহত ব্যবসায়ী করিম বক্স মামুন হত্যা মামলা গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) স্থানান্তর হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়- মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে সিলেট নগরীতে বাকবিতণ্ডার জের ধরে প্রাণ দিতে হয়েছে জিন্দাবাজারের ব্যবসায়ী মামুন, লালাবাজারের শাকিল আহমদকে। প্রেমঘটিত সমস্যার কারণে প্রাণ দিতে হয় কানাইঘাটের ইমরানকে, নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা ও নূরজাহান কলেজের ছাত্রী ফাতেমাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রীকে অপহরণ করে তুলে নেয়ার চেষ্টার ঘটনাও ঘটেছে। আর পারিবারিক বিরোধের জেরে প্রাণ দিতে হয় সিলেট নগরীর শেখঘাট এলাকার বাসিন্দা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা তাজুল ইসলামকে।
গত ১৫ মার্চ রাতে নগরীর রায়নগরে ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় নগরীর রায়নগরে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন বিকল। এ ঘটনায় বিকলের বড় ভাই বিশ্বজিত রায় বাদী হয়ে ৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৫-৬ জনকে আসামি করে মামলা কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন।
গত ৩ অক্টোবর শাবি ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুলের হামলার শিকার হন সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ডিগ্রি ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী খাদিজা আক্তার নার্গিস। এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে খাদিজকে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক আহত করেছে বদরুল। এ লোমহর্ষক ঘটনায় দেশজুড়ে চলছে তোলপাড়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে আহত কলেজ ছাত্রী খাদিজা।
গত ৪ অক্টোবর সোবহানীঘাটের হোটেল মেহেরপুর থেকে শাকিল নামের এক ব্যবসায়ীর গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শাকিল আহমদ দক্ষিণ সুরমার মোগলাবাজারের শ্রীরামপুরের লাল মিয়ার ছেলে বলে জানা গেছে। তবে এ ঘটনায় পুলিশ দাবি করছে শাকিল সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
এছাড়াও গত ৪ সেপ্টেম্বর সিলেটের কানাইঘাটের টেইলার্স ব্যবসায়ী ইমরান হোসেনের লাশ বন্তাবন্দি অবস্থায় পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়। এসময় ইমরানের হাত ও পা ভাঙ্গা গলা কেটে, লিঙ্গ কর্তন করে, হাত ও পা ভেঙ্গে হত্যার পর রাতের আঁধারে তার লাশ চটের বস্তায় ভরে বস্তার নীচ অংশে গাছের সাথে বাঁধা অবস্থায় পুকুরে ডুবিয়ে রাখা ছিল। এ ঘটনায় ইমরানের প্রেমিকা সুহেদা কেগমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরবর্তীতে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে প্রেমিক ইমরান হোসেনকে খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে ইমরানের কথিত প্রেমিকা সুহাদা বেগমসহ গ্রেফতারকৃত আরো ৩ জন।
সিলেটে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে সর্বশেষ খুনের ঘটনা ঘটে গত ১৬ আগস্ট। সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারের এলিগেন্ট শপিং সিটির পার্কিংয়ের সামনে মোটরসাইকেল রাখা নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে জেলা ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সহ-সভাপতি এম. সুলেমান হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে ওই মার্কেটের ব্যবসায়ী করিম বক্স মামুনকে ছুরিকাঘাত করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঐদিন দিবাগত রাতেই মামুন ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। এ ঘটনায় পরদিন সুলেমান হোসেন চৌধুরীকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে।
১৯ আগস্ট শুক্রবার দক্ষিণ সুরমার লালাবাজারে বাক্বিত-ার জেরে ছাত্রলীগ নেতা আজাদের নেতৃত্বে খুন করা হয় আজির মিয়া (৪৫) নামের এক ফার্মেসি মালিককে।
গত ২০ আগস্ট শনিবার দুপুর সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার চণ্ডিপুরে এলাকায় প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না-দেওয়ার কারণে নূরজাহান কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তারকে ছুরিকাঘাত করে লিটন নামের এক বখাটে। এসময় স্থানীয়দের সহযোগিতায় গুরুতর আহত অবস্থায় ফাতেমাকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এসময় বখাটে লিটনকে আটক করা হয়। এদিকে, একই দিন ২০ আগস্ট রাত ১০টার দিকে নগরীর কুয়ারপাড় গরম দেওয়ান মাজার এলাকায় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর শাহানা বেগম শানুর স্বামী এবং স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা তাজুল ইসলামকে কুপিয়ে খুন করে সন্ত্রাসীরা। তবে এ ঘটনার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে পূর্ব বিরোধের জের ধরে তাজুলের উপর হামলা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। এর আগে পারিবারিক বিরোধকে কেন্দ্র করে তাজুল ইসলামের ছেলে রায়হান ইসলামকে খুন করে প্রতিপক্ষের লোকজন। এর বদলা নিতে তাজুল ইসলাম খুন করে তার প্রতিপক্ষ।
চলতি বছরের ১০ জুলাই নগরীর পাঠানটুলায় একটি বাসার দখল নিয়ে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় খুন হন স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা আব্দুল্লাহ অন্তর। এ ঘটনায় অন্তরের স্ত্রী বাদি হয়ে বিমানবন্দর থানায় মামলা দায়ের করলেও এখনো হত্যাকাণ্ডের মূলহোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
গত ১ মে নগরীর শামীমাবাদে ইসলাম হোসেন নামের এক শ্রমিককে কুপিয়ে খুন করে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। এ ঘটনায় নিহতের ভাই বাদি হয়ে থানায় মামলা করলেও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা ধরা পড়েনি। ৮ জানুয়ারি সিলেট সদর উপজেলার খাদিম বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বনফুলের তাফু ও রাজু নামের দু’জন শ্রমিক নিহত হন।
এছাড়াও চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি সিলেট সফরে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগের দিন নিজ দলের ক্যাডারদের হামলায় নিহত হন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ ৪র্থ বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগকর্মী কাজী হাবিবুর রহমান হাবিব।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৪ ছাত্রকে বহিষ্কার করে। এদের সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ও ওই হত্যা মামলার আসামি।