সিলেটের খাসিয়া সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় জীবনগাঁথা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ অক্টোবর ২০১৬, ৩:৪৫ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
বাংলাদেশের মধ্যে সিলেটে বসবাস করেন নানা ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ। এ জনপদে রয়েছে বহুভাষা ও বৈচিত্র্যমন্ডিত সাংস্কৃতিক আবহ। তবে, সিলেট জেলায় যে কয়টি সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন তার মধ্যে খাসিয়া সম্প্রদায় একটি। বৃহত্তর সিলেটে এই সম্প্রদায়ের ৭২টি পুঞ্জি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী বসবাস জাফলং এলাকায়। বর্তমানে জাফলংয়ে ৪টি পুঞ্জি রয়েছে। জৈন্তায় রয়েছে আরো দুটি পুঞ্জি। প্রতিটি পুঞ্জিতে গড়ে ৫০টি পরিবার বাস করে। খাসিয়াদের ভাষার নাম খাসি বা খাসিয়া। তারা সাধারণত রোমান হরফে লেখে। গান, কবিতা থেকে শুরু করে নাচ, নাটক, গল্প শিল্প-সাহিত্যের সব শাখাই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। লোককথা, পৌরাণিক কাহিনী, তন্ত্র-মন্ত্র ইত্যাদি খাসিয়া সংস্কৃতির জীবনবোধে সমৃদ্ধ। কিন্তু মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় সেই জীবনবোধ অনুধাবনের প্রাতিষ্ঠানিক উপায় নেই।
জানা যায়,প্রায় ছয়-সাতশ’ বছর আগে আসাম থেকে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে তারা সিলেট চলে আসে। তারপর জাফলংয়ের জৈন্তা রাজার অধীনে টিলার ওপর তারা পুঞ্জি স্থাপন করে। বর্তমানে খাসিয়া সম্প্রদায়ের ৪টি পুঞ্জি রয়েছে সেখানে। তার মধ্যে বল্লা পুঞ্জি, সংগ্রাম পুঞ্জি, নকশিয়া পুঞ্জি ও । একইভাবে জৈন্তায় আছে মোকামপুঞ্জি ও নিজপাট খাসিয়া হাটি। এক একটি পুঞ্জিতে অন্তত ৫০টি পরিবার বসবাস করে। সিলেট জেলার জাফলং, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট উপজেলায়; মৌলভীবাজারের সবকটি উপজেলায়, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট ও বাহুবল উপজেলায়; সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় খাসিয়াদের মূল বসবাস। অনেকের মতে,নেত্রকোণা জেলার কিছু জায়গায় খাসিয়াদের লিঙাম (খুহমধস) ভাষাভাষি গোত্র বাস করে। যারা অনেকটা অবহেলিত। গারোদের সান্নিধ্যে থাকার কারণে এবং বৈবাহিক সম্পর্ক সূত্রে অনেকেই এদেরকে গারো বলে ভুল করেন। এজন্য অবশ্য লিঙাম গোত্রীয়রাই দায়ী। এদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেকে গারো আবার অন্যরা নিজেকে খাসিয়া পরিচয় দিতে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করছে। তবে নৃবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের বাইরে পূর্ব ভারতের মেঘালয়, আসাম ইত্যাদি রাজ্যগুলোতে খাসি ভাষী লোক রয়েছে।
গারোদের মতো খাসিয়ারা মূলত মাতৃতান্ত্রিক সম্প্রদায়। এ কারণে খাসিয়া সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের বিশেষ সম্মান ও আলাদা মর্যাদা রয়েছে। এদের পরিবারের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন নারী। নারীরা কনেযাত্রী নিয়ে বিয়ে করে বর নিয়ে আসেন বাড়িতে। আর নারীরা নিজেদের বাড়িতেই বাবা-মায়ের সাথে স্বামী-সন্তানসহ বসবাস করে থাকেন। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিচালিত খাসিয়াদের কোনো পুরুষ সম্পত্তির মালিক হন না। সকল সম্পদের মালিক হন নারীরা। স্ত্রীর বাড়িতে পুরুষেরা কাটিয়ে দেন পুরোটা জীবন। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ মেয়ের ধনসম্পদে বেশি প্রাধান্য থাকে। এদের বংশ পরিচয় দেয়া হয় মায়ের বংশানুক্রমে। খাসিয়া মেয়েরা দুই খন্ড কাপড় পরিধান করে। এক খন্ড ঊর্ধ্বাঙ্গে আরেক খন্ড নাভির নিচে। শিশুদের পিঠে বেঁধে সাধারণত চলাফেরা করে। খাসিয়া মেয়েরা বাজারহাটে কেনাবেচা করে ও ভ্রমণ পছন্দ করে। খাসিয়া সম্প্রদায়ের আদি পেশা পান চাষ। খাসিয়ারা পান চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তারা পান চাষের উপযোগী এলাকায় টিলার ওপর ঘর বেঁধে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। জুম চাষও তাদের আরেক উল্লেখযোগ্য পেশা। এছাড়াও তারা বিভিন্ন পতিত ভূমিতে শাক সবজি ও ফলমুলের চাষ করে। খাসিয়াদের উৎপাদিত পান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর খাসিয়া রাজতন্ত্রের অবসান হলেও আজো অতীত সমাজ ব্যবস্থাতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে তারা। তাদের সমাজের কর্তাব্যক্তিকে বলা হয় মন্ত্রী। রাজার আমলে নিয়োজিত বংশ পরম্পরায় মন্ত্রীরা প্রতিটি পুঞ্জির বিচারক। অনুসন্ধানে জানা যায়, খাসিয়া আদিবাসীরা ছয়টি গোত্রে বিভক্ত। গোত্রগুলো হলো লেংদু, সিংতে, লিংগাম, পনার, ভুই ও বার। ছয়টি গোত্রের মানুষ একই পুঞ্জিতে মন্ত্রীর অধীনে বাস করে। খাসিয়াদের নিজ গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। অন্য গোত্রের সাথে বিয়ে দিতে হয়। খাসিয়াদের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। নৃত্য-সঙ্গীত তাদের খুবই প্রিয়। নানা ধরণের নাচগানে সবাই একত্র হয়। বিশেষত বড়দিনে আনন্দ উৎসব করে। খাসিয়ারা এক সময় প্রকৃতি-পূজারী ছিল। এখন খ্রিষ্টান মিশনারীদের মাধ্যমে এদের প্রায় বেশির ভাগই খ্রিষ্টান। তবে এর পাশাপাশি তারা বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করে। তাদের ছেলেমেয়েরা এখন মিশনারি স্কুলে লেখাপড়া শিখছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিশিষ্ট সমাজ গবেষক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, খাসি ভাষার কোন বর্ণমালা ছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে আজ পর্যন্ত প্রাচীন বর্ণমালার কোন নিদর্শন আবিস্কৃত হয়নি এবং বলা যায়, এটি শুধু মৌখিক ভাষা হিসেবে ছিল অনেক কাল ধরে। ১৮১৩-১৪ সালে কৃষ্ণ চন্দ্র পাল নামে একজন ধর্মযাজক বাংলা বর্ণমালা দিয়ে খাসি ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন, এটাই খাসি ভাষায় বাংলা হরফে লেখা প্রথম নিদর্শন। একই সময়ে উইলিয়াম কেরি নামে একজন ইংরেজ ধর্মযাজক সিলেটের নাগরী লিপি দিয়ে খাসি ভাষা লেখার প্রচলন করেন। এরপর অবশ্য ১৮৩৮ সালের পর হতে রোমান হরফে খাসিয়া ভাষা লিখিত হতে থাকে। ওয়েলস ক্যালভিনিস্টিক মিশনারী দলের টমাস জোনস রোমান হরফে খাসিয়া ভাষা লেখার প্রচলন করেন (সিকদার, ২০০৮); পরবর্তীতে বিদ্যালয় এবং চার্চে খাসি ভাষায় লেখালেখির কাজটাকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার পর্যায়ে উন্নীত করতে সাহায্য করেন জন রবার্টস নামে আরেকজন ধর্মযাজক। বাংলা হতে রোমান হরফে উল্লম্ফনের পিছনে চার্চ এবং মিশনারী কাজের ভূমিকাই নিয়ামকশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। বর্তমানে এ হরফেই সাহিত্যচর্চা হচ্ছে। খাসিয়া বর্ণমালায় রয়েছে ২৩ টি বর্ণ-এর মধ্যে ৭টি স্বরবর্ণ এবং ১৬টি ব্যঞ্জনবর্ণ। খাসি বর্ণমালায় ৬টি ইংরেজী বর্ণ নেই। এগুলো হল, ঈ, ঋ,ছ, ঢ, ঠ, ত. বিশ্বখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী গ্রিয়ারসনের মতে, খাসি ভাষা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের মোন-খমের শাখা হতে উদ্ভূত। এ ভাষা পরিবারের আরেকটি শাখা হল মুন্ডারি, যাতে সাঁওতাল, মুন্ডা এবং ওঁরাও ভাষা রয়েছে। আর এজন্যই বাংলাদেশের সাঁওতাল, মুন্ডা এবং ওঁরাও ভাষার সাথে খাসি ভাষার মিল পাওয়া যায়। তবে ব্যাকরণ, শব্দ চয়ন ও শব্দ গঠনে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। বাংলা বর্ণের ঋ, গ, ড, ঢ, ড়, ঢ়, ণ, ষ, হ- ইত্যাদি বর্ণগুলোর কোন খাসি উচ্চারণ নেই। অন্যদিকে, খাসিতে এ, ন-এই বর্ণগুলির মহাপ্রাণ ধ্বনি রয়েছে- যা প্রকাশের জন্য বাংলায় আলাদা কোন বর্ণ নেই। মায়ানমারের পালুং বিয়াং ওয়া, কম্বোডিয়ার খমের, থাইল্যান্ডের লেমেট-খুমু, মালয়েশিয়ার সাকাই সেমাং, উপমহাদেশের পালি, প্রাকৃতবাংলা ও সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষা হতে বিভিন্ন শব্দ খাসি ভাষায় প্রবেশ করেছে। পরবর্তীকালে ভৌগোলিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা ও প্রশাসনিক, মামলা-মোকদ্দমা, ভূমি বন্দোবস্তী ইত্যাদি অনেক কারণে প্রচুর বাংলা শব্দ খাসি ভাষায় অবিকৃত অবস্থায়, অথবা আংশিক পরিবর্তিত হয়ে প্রবেশ করেছে এবং তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। অন্যান্য ভাষার মতো খাসি ভাষা অঞ্চলেও কয়েকটি আঞ্চলিক ভাষার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। অঞ্চলভেদ বিচার করে খাসি ভাষাকে প্রধান চারটি ভাষা অঞ্চলে ভাগ করেছেন, এগুলো হচ্ছে- ক) ওয়ার ( কুলাউড়া অঞ্চলের খাসি ভাষা), খ) প্নার (ভারতের মেঘালয়ে এবং সিলেটের জৈন্তিয়ায় বসবাসকারীদের ভাষা) গ) আমজলং (মৌলভীবাজারে প্রচলিত খাসি ভাষা) এবং ঘ) নংউয়া (সুনামগঞ্জে প্রচলিত খাসি ভাষা)।
তরুণ সমাজ গবেষক আবদুল হাই আল হাদি জানান, বাংলাদেশের মধ্যে সিলেটে খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস বেশী। তাদের প্রধান পেশা পান সুপারী এবং জুম চাষ। তাদের অনেকে শাকসবজি এবং ফলমূলও চাষ করে। তবে, শিক্ষায় অনেকটা পিছিয়ে আছে তারা। তিনি বলেন, এই জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আরো কিছু থাকলেও সিলেটে বেশী। এজন্য তাদের জীবন মান উন্নয়নে সরকারের সুদৃষ্টি প্রয়োজন।
নকশিয়া পুঞ্জির জমিদার শেফাল লাম্বা জানান,আমাদের জমিও নির্দিষ্ট, তাই জনসংখ্যাও কম। আমাদের শিশুরা খুব একটা বিদ্যালয়মুখী নয়। আমাদের মধ্যে সব সময় শান্তি শৃংখলা আছে। তিনি বলেন, আমাদের পান সুপারী বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যায়।
স্থানীয় আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো) নামে একটি সংগঠন। এ সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মী কান্ত সিংহ জানান, খাসিয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা রক্ষা করা দরকার। কারণ আমাদের মানচিত্র থেকে অনেক ছোট ছোট সম্প্রদায় ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে। এখনো যেগুলো টিকে আছে, তাদেরকে দেশের স্বার্থে রক্ষা করা দরকার।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক এ.কে.এম মাজহারুল ইসলাম এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বাংলাদেশের মধ্যে শুধু সিলেটে খাসিয়ারা বসবাস করে। বিশেষ করে জৈন্তাসহ আরো কয়েকটি এলাকায়। তাদের নিজস্ব ভাষা নিয়ে রয়েছে ভিন্ন মত। তবে তারা যে ভাষায় কথা বলে সেটি হচ্ছে ‘খাসি’ ভাষা।