সিলেটের ১২ নদী ভারতের পানি আগ্রাসনের কবলে, পরিণত হচ্ছে মরা নদীতে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ অক্টোবর ২০১৬, ৩:৫৬ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
ভারতের পানি আগ্রাসনের কবলে সিলেটের ১২টি আন্তঃসীমান্ত নদী। উজান থেকে পানি প্রত্যাহারের ফলে সিলেট হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবাহিত এই নদীগুলো ক্রমেই স্রোতহীন হয়ে পড়ছে। পরিণত হচ্ছে মরা নদীতে। তবে টিপাইমুখ বাঁধ ছাড়া অন্যান্য নদীতে ভারতীয় আগ্রাসনের বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মোটেই আলোচিত হয়নি। অবশেষে টিপাই বাঁধবিরোধী আন্দোলনও একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে। গত ৪ বছর ধরে এ আন্দোলনে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি রাজনৈতিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও চুপ। আন্দোলনে সম্পৃক্তদের কারোরই মুখে এখন ভারতের পানি আগ্রাসনের কথা শোনা যায় না। রহস্যময় এমন নীরবতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা সন্দেহের উদ্রেক হচ্ছে। সম্প্রতি ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হলেও টিপাইমুখের বাঁধ ইস্যুটি স্থান পায়নি।
২০০৯ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১শ’ কিলোমিটার উজানে ভারতের বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। টিপাইমুখ নামক গ্রামে বরাক এবং টুইভাই নদীর মিলনস্থলে ১ হাজার ৬শ’ ফুট দূরে বরাক নদীতে ৫শ’ ফুট উঁচু ও ১ হাজার ৬শ’ ফুট দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। সেখানে ১ হাজার ৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে ভারত সরকার কাজ শুরু করেছে। অভিন্ন নদীর উজানে এ বাঁধ বাংলাদেশের পরিবেশ ও অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে এমন আশংকা বিশেষজ্ঞদের। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জায়েদা শারমিন স্বাতী বলেন, যে কোনো নদীর উৎসমুখে বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ করলে পরিবেশে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। টিপাইমুখে বাঁধের ফলে সিলেট তথা সমগ্র দেশে কৃষি, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়ার আশংকা রয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশ ও ভারতের কয়েকটি রাজ্যের প্রবল আপত্তির পর আন্তর্জাতিক নদীশাসন আইন উপেক্ষা করে দেশ-বিদেশে আলোচিত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করতে চায় ভারত। ২০০৯ সালে ভারত এ প্রকল্পের কাজ শুরু করলে সিলেটসহ সারা দেশে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। সিলেটে বিভিন্ন রাজনৈতিক, পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠন মিলে ‘টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিরোধ আন্দোলন’ কমিটি গঠন করা হয়। ৫০১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির আহ্বায়ক করা হয় প্রবীণ রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট বেদানন্দ ভট্টাচার্যকে। পৃথক আন্দোলন শুরু করে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। শুরু হয় মিছিল, সমাবেশ, সেমিনার, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি। এসব কর্মসূচির কারণে উত্তাল হয়ে ওঠে সিলেট। সিলেট থেকে জকিগঞ্জ সীমান্তে লংমার্চ করে বিএনপি। এতে নেতৃত্ব দেন নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেনি ‘টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিরোধ আন্দোলন’ কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট বেদানন্দ ভট্টাচার্য বলেন, আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়েনি। আমাদের আন্দোলনের ফলে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দেয় ভারত সরকার। বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে পুনরায় দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। তিনি বলেন, টিপাইমুখে বাঁধ হলে সুরমা ও কুশিয়ারা উপত্যকায় জনজীবন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের পানিপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে বাঁধ কর্তৃপক্ষের হাতে। ফলে জীব-বৈচিত্র্যের পরিবর্তন হয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মেঘনা মোহনায় মিঠা পানির প্রবাহ কমে লোনা পানি ঢুকে পড়ার আশংকা রয়েছে। যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন বলেন, টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হলে ভারতের আসাম, মিজোরাম ও মণিপুর এবং বাংলাদেশে এর বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন শুরু হয়। একপর্যায়ে তীব্র আন্দোলনের মুখে ভারত সরকার কাজ বন্ধ করে দেয়। তিনি বলেন, টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে সরকারের তেমন গরজ নেই। সরকারের উচিত টিপাইমুখে যাতে বাঁধ নির্মাণ না হয় সে ব্যাপারে কূটনৈতিক আলোচনা করে স্থায়ী সমাধান করা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তের সারি নদীর উৎসস্থল মেঘালয় রাজ্যের মাইণ্ডু নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে ১২৬ মেগাওয়াট পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে ভারত।