ব্রিটেনে বাঙ্গালী পাড়ায় বেপরোয়া ব্রিটিশ পুলিশ : নতুন ভিডিওতে তোলপাড়
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ অক্টোবর ২০১৬, ৯:২৪ অপরাহ্ণ
লন্ডন অফিসঃ পূর্ব লন্ডনের বাঙালি তরুণের ওপর পুলিশি ‘নিষ্ঠুরতার’ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই জনসমক্ষে এসেছে পুলিশি নিষ্ঠুরতার আরও একটি ভিডিওচিত্র। প্রকাশ হওয়া নতুন ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ১৩ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রীকে হাতকড়া পরিয়ে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন টাওয়ার হ্যামলেটসের এক পুলিশ সদস্য। গত ৮ অক্টোবর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুবক জাকারিয়া হোসাইনের সাথে পুলিশের জবরদস্তিমূলক আচরণের ভিড়িও প্রকাশিত হয়। ওই ঘটনা পুলিশের আচরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ নিয়ে চলমান হইচইয়ের মধ্যেই কিশোরী স্কুলছাত্রীর ওপর পুলিশের নিষ্ঠুর আচরণের ভিডিওচিত্রটি প্রকাশ পেল। বেথনাথ গ্রিন একাডেমির শিক্ষার্থী ১৩ বছর বয়সী ওই ছাত্রীর সাথে পুলিশের জবরদস্তিমূরক আচরণের ঘটনাটি ঘটে গত ৫ অক্টোবর। এই ছাত্রীর পরিবারের পুলিশের আচরণের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছে, তাদের কিশোরী মেয়েকে পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে মেঝেতে এক খণ্ড মাংসের মত টেনেহিচড়ে নিয়ে গেছে।
৮ অক্টোবরের ঘটনার পর ৫ অক্টোবরের ওই ঘটনার ভিড়িও প্রকাশিত হওয়ার ঘটনায় টাওয়ার হ্যামলেটসের পুলিশের আচরণ নিয়ে রীতিমত তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, পরপর এই দুটি ঘটনা প্রমাণ করে এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং টাওয়ার হ্যামলেটসের পুলিশ অনেকটা এমন জবরদস্তিমূলক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে। এসব ঘটনার প্রতিবাদে আগামী ২৯ অক্টোবর শনিবার আলতাব আলী পার্কে এক গণবিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন স্থানীয় কমিউনিটি। এই বিক্ষোভ থেকে দুটি ঘটনায় জড়িত দুই পুলিশ কর্মকর্তার অপসারণ দাবি করার পাশাপাশি টাওয়ার হ্যামলেটসের বারা কমান্ডার স্যু উইলিয়ামের পদত্যাগ দাবি করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বর্ণবাদ ও পুলিশি জবরদস্তিমূলক আচরণ বন্ধে সোচ্চার সকলকে ওইদিন বিকাল ২টায় গণবিক্ষোভে সামিল হওয়ার আহবান জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, ৫ অক্টোবর পুলিশের জবরদস্তিমূলক আচরণের শিকার হওয়া ১৩ বছর বয়সী কিশোরীর নাম ক্যাটেলিন মারফি কিং। সে বেথনাল গ্রিন একাডেমির শিক্ষার্থী। তার পরিবার বেথনাল গ্রিনের চেমসফোর্ড স্ট্রীটের বাসিন্দা। ঘটনার দিন ৫ অক্টোবর এক বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য তার জমজ বোনকে নিয়ে ক্যাটেলিন কমার্শিয়াল রোড়ের ওয়াপিং হাইস্কুলে যায়। সেখানে স্কুল গেইটে ওই স্কুলের এক ছাত্রীর সাথে ক্যাটেলিনার বাকবিতণ্ডা হয়। ওই ঘটনার সুরাহা করতে গিয়েই পুলিশ অতিমাত্রায় বলপ্রয়োগ এবং নিষ্ঠুর আচরণ করেছে বলে অভিযোগ।
ক্যাটেলিনার সঙ্গে থাকা বোন পুরো ঘটনাটি তার মোবাইলে ধারণ করে। এক পর্যায়ে মোবাইল থেকে ওই ভিডিওচিত্র মুছে ফেলার জন্য পুলিশ হুমকিধামকি দিয়েছে বলেও অভিযোগ। জাকারিয়া হোসাইনের সাথে পুলিশের করা আচরণ নিয়ে হইচই শুরু হলে ক্যাটেরিনার পরিবারও ওই ভিডিওটি প্রকাশ করে দেয়।
ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, পুলিশ মাত্র ১৩ বছর বয়সী ক্যাটেলিনাকে মেঝেতে ফেলে হাতকড়া পরিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ক্যাটেলিনার নানী ৫১ বছর বয়সী জোয়ান হোয়াইটেকার স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, পুলিশ কর্মকর্তা কোনো প্রাপ্তবয়স্ক লোককে নিবৃত্ত করছিলেন না। মাত্র ১৩ বছর বয়সী একটা কিশোরী। তার প্রতি এমন বলপ্রয়োগ এবং জবরদস্তিমূলক আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তিনি বলেন, সেখানে দুটি কিশোরী মেয়ে ঝগড়া করছিলো। তারা একজন আরেকজনের গায়ে হাতও তুলেনি। কিন্তু তাদের থামাতে গিয়ে পুলিশ সীমা অতিক্রম করলো। ভুক্তভোগী কিশোরীর নানী আরও বলেন, মেয়েটি পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তি করছিলো এমনও নয়। সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু পুলিশ তাকে মাংসের দলার মত টানাহেঁচড়া করলো। কিশোরীর শরীরে ক্ষতচি? ও ফোলা দাগ ছিল বলে জানান তিনি। পুলিশের আচরণকে তিনি জঘণ্য বলে মন্তব্য করেন।
এই পরিবার পুলিশ ও ইন্ডিপেনডেন্ট পুলিশ কমপ্লেইন্ট কমিশনের কাছে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করে। এর প্রেক্ষিতে বিষয়টি স্থানীয়ভাবে তদন্ত হবে বলে তাদের জানানো হয়।
আইপিসিসির একজন মুখপাত্র বলেন, মেট্রোপলিটান পুলিশের মাধ্যমে তারা ৫ অক্টোবর ওয়াফিং স্কুলের একটি ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছে। সতর্কতার সাথে বিষয়টি বিবেচনার পর স্থানীয়ভাবে মেট্রোপলিটান পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় আইপিসিসি।
ওয়াপিং স্কুলের এক বিবৃতিতে বলা হয়, আমাদের স্কুলের বাইরে অন্য একটি স্কুলের শিক্ষার্থীর আচরণ নিয়ে এবং আমাদের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ ডাকা হয়। বিষয়টি এখন পুলিশ দেখভাল করছে। মেট্রোপলিটান পুলিশ জানায়, তারা ঘটনার দিন বিকাল ৪টা ১৫ মিনিটে খবর পেয়ে ওয়াপিং স্কুলে যায়।
এদিকে পরপর দুটি ঘটনায় বেশ চাপে পড়েছে টাওয়ার হ্যামলেটস পুলিশ। পুলিশের কার্যকলাপ নজরদারি করা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিপেনডেন্ট পুলিশ কমপ্লেইন্ট কমিশন (আইপিসিসি) এসব ঘটনা তদন্তে এগিয়ে এসেছে। বিষয়গুলো নিয়ে কঠিন প্রশ্নের সম্মুখিন হচ্ছেন টাওয়ার হ্যামলেটস পুলিশের নতুন বারা কমান্ডার স্যু উইলিয়ামস। গত শুক্রবার বারা কমান্ডার জানান, দুটি ঘটনায় জুড়িত দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে মাঠের কোনো দায়িত্বে পাঠানো হচ্ছে না। ঘটনার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কাজ ডেস্ক ডিউটিতে সীমিত রাখা হয়েছে।
এর আগে ৫ অক্টোবরের ঘটনায় ওই পরিবার অভিযোগ করলে পুলিশ জানায় যে, স্থানীয়ভাবে বিষয়টি তদন্ত করা হবে। এখন টাওয়ার হ্যামলেটসের বারা কমান্ডার জানাচ্ছেন, দুটি ঘটনাই তদন্ত করবে আইপিসিসি। বারা কমান্ডার স্বীকার করেন যে, দুটি ঘটনায় কমিউনিটিতে পুলিশের সম্পর্কে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি করেছে। তিনি বিষটিকে বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন বলে জানান।
প্রসঙ্গত, গত ৮ অক্টোবর স্থানীয় একটি ইয়ুথ প্রজেক্টের ম্যানেজার জাকারিয়া হোসেইনের সাথে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার ‘নিষ্ঠুর’ আচরণের ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় কমিউনিটিতে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন স্থানীয় জনসাধারণ। এই পরিস্থিতিতে মেট্রোপলিটন পুলিশ তাদের কর্মকর্তার আচরণ তদন্তের পদক্ষেপ নেয়। আইপিসিসির বক্তব্য থেকে জানা গেছে, খোদ মেট্রোপলিটান পুলিশ সার্ভিসই বিষয়টি তাদের কাছে তদন্তের জন্য পাঠিয়েছে। জানা গেছে, স্টেপনি গ্রীনে নিজ কর্মক্ষেত্রের পাশে পুলিশ কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়া জাকারিয়া হোসাইন সাউথ ব্যাংক ইউনিভার্সিটি থেকে ল গ্রাজুয়েট। ২৬ বছর বয়সী জাকারিয়া স্টেপনি গ্রীনের আরবার ইয়ুথ সেন্টারের প্রজেক্ট ম্যানেজার। গত ৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় সন্দেহজনক পাবলিক অর্ডার অফেন্সের অভিযোগে পুলিশ জাকারিয়াকে আটক করলেও পরে তাকে জামিনে ছেড়ে দেয়।
এদিকে পুলিশের আচরণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় এমপি রুশনারা আলী। ঘটনার ভিডিওচিত্র দেখে এক বিবৃতিতে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এ ঘটনার কিছু প্রশ্নের জবাব জরুরী ভিত্তিতে পাওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বারা কমান্ডারের সাথে তিনি যোগাযোগ করেছেন বলে বিবৃতিতে জানান।
এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি অন্যরাও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। কেউ কেউ অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের শাস্তি ও বরখাস্তের দাবি জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য করতে থাকেন।