সিলেটের দুই ট্রাভেল এজেন্সির নতুন ফাঁদ লিবিয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ অক্টোবর ২০১৬, ১২:১৬ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে লিবিয়ায় মানব পাচার করছে সিলেটের দুই ট্রাভেল এজেন্সি। লিবিয়া প্রবাসী দুই বাংলাদেশির যোগসাজশে চলছে এ মানব পাচার। ভুয়া ভিসায় এ মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছে দেশের ৩০ দালাল। আর তাদের সহযোগিতা করছে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনসহ বিভিন্ন শাখায় কর্মরতদের একটি চক্র। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গত বুধবার সকালে ইমিগ্রেশনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইটে দুবাই ও তুরস্ক হয়ে লিবিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন ২১ জন। তবে একইভাবে লিবিয়া যাওয়ার সময় বিমানবন্দর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৩৯ জনকে।
শাহ আমানত দিয়ে লিবিয়ায় মানব পাচারে জড়িত থাকার ঘটনায় সিলেটের আল মামুন ট্রাভেলসের মালিক মো. মামুন ও শামীম ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক আদনান আনসারীর নাম পেয়েছে র্যাব-৭। লিবিয়ায় বসবাসরত সাদিক ও মোজাম্মেল নামে দুই ব্যক্তি ভুয়া ভিসা দিয়ে প্রতারণা করছেন বলেও তারা জানতে পেরেছে। উদ্ধারকৃতদের কাছ দালালদের নাম পাওয়া গেছে। তার মধ্যে রয়েছে সিলেটের মো. লিলু, মতিউর রহমান, মো. সাইদুর, তফুর আলী, মো. ইউছুপ, আজিজুল হক শাহীন, মো. শাজিন, মো. নাসির, আজাদ তালুকদার, মো. আলমগীর, তুহিন, মো. খোকা, মো. রুমেন, মো. শাহিন, ঢাকার রাজীব, এসডি রহমান, মো. কামাল, মো. সিরাজ, মো. ফারুক, মো. হারুন, বতুল মেম্বার, মো. কাদের, দ্বীন ইসলাম, মো. স্বপন, আল আমিন মাতব্বর, ওহাব, শরীফ, রানা ও কুদ্দুস সরদার।
র্যাব-৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন বলেন, ‘দালালদের গ্রেফতারে অভিযান চালানোর জন্য র্যাবের সব জোনে তালিকা পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের কোনো ট্রাভেল এজেন্সি কিংবা দালাল এই কাজের সঙ্গে যুক্ত আছে কি-না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ভুয়া ভিসার বিষয়ে মিফতাহ বলেন, ‘৩৯ জনের মধ্যে যাদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হয়েছে তাদের প্রত্যেকের ভিসা ইস্যুর তারিখ ৫ অক্টোবর। প্রত্যেকেকে ৩০ দিনের ভিসা দেওয়া হয়। বাকি ২০ জনের মধ্যে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এমন ভিসা আছে দুটি। ১০ জুনের চারটি ভিসার ফটোকপি আছে। বাকি সব ভিসার মেয়াদ মাত্র একদিন। তদন্তে জেনেছি সব ভিসাই ভুয়া। ভুয়া ভিসা নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
র্যাব-৭ কর্মকর্তারা জানান, সিলেটের বাসিন্দাদের অধিকাংশকে লিবিয়া হয়ে ইতালি নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। বাকিদের লিবিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য জড়ো করা হয়েছিল। ৩৯ জনের মধ্যে ১৯ জন ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগের অনুমতি পেয়েছিলেন। কিন্তু গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ভুয়া ভিসার বিষয়টি জানতে পেরে তাদের বিমানে ওঠার আগে আটকাতে সক্ষম হন র্যাব কর্মকর্তারা। ২০ জনকে বিমানবন্দরে প্রবেশের আগে আটকানো হয়। তবে ২১ জন ভুয়া ভিসা নিয়ে লিবিয়া চলে গেছে।
লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা অভিযান শুরুর সময়ই ২১ জন বিমানে উঠে যায়। পাইলটের অনুমতি না পাওয়ায় তাদের নামানো যায়নি। তবে ২১ জনের বিষয়ে আমরা লিবিয়া দূতাবাসকে জানিয়েছি। লিবিয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। সেখানে কাজের জন্য গিয়ে লাভ নেই। যাদের লিবিয়া নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে তাদের সঙ্গে আসলে প্রতারণা করা হচ্ছে। তাদের চট্টগ্রাম থেকে দুবাই হয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুল অথবা আঙ্কারায় নিয়ে যাওয়া হতো। তারপর সেখান থেকে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে নিয়ে যাওয়া হতো। এরপর লিবিয়া বিমানবন্দর থেকে দালাল সাদিক ও মোজাম্মেল তাদের নিজেদের জিম্মায় নিত। এরপর চলত টাকা আদায়ের জন্য নির্যাতন।’
উদ্ধারকৃতরা জানিয়েছে, লিবিয়া যাওয়ার জন্য চার লাখ ২০ হাজার টাকা এবং লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য সাড়ে চার লাখ টাকায় তারা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। তবে ৩৯ জনের মধ্যে শুধু একজন এক লাখ টাকা এবং আরেকজন ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছে। অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা দেওয়া সিলেটের কুলাউড়ার হাশিম জানান, স্থানীয় দালাল ওহাবের সঙ্গে ইতালি যাওয়ার জন্য তার সাড়ে চার লাখ টাকা চুক্তি হয়েছিল। অগ্রিম এক লাখ টাকা দেওয়া সিলেটের গোলাপগঞ্জের মুমিত আহমেদ জানান, প্রথমে সরাসরি ইতালি যেতে পারব জানার পর এক লাখ টাকা দিয়েছিলাম। বাকি টাকা ইতালি গিয়ে কাজ করে দেওয়ার কথা ছিল। শরীফ নামে লন্ডনে বসবাসরত এক দালালের মাধ্যমে সে ইতালি যাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করে। দুই মাস আগে শরীফ লন্ডনে পাড়ি জমায়।
গত বুধবার বিমানবন্দর থেকে উদ্ধার হওয়া ৩৯ জনের অধিকাংশই সিলেটের বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। উদ্ধারকৃতরা জানান, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ৮-১০ জন করে মাইক্রোবাসে করে এনে তাদের একত্র করে দালালরা। ঢাকার যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মেহেদী হাসান বলেন, ‘রানা নামে এক দালালের সঙ্গে আমার চুক্তি হয়। চার লাখ টাকায় আমাকে ইতালি পৌছে দেওয়ার কথা ছিল। দুই দিন আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসি। দালালের নির্দেশমতো নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজার হোটেল আল ছালামতে উঠি।’ আবদুর রশিদ নামে অন্য একজন বলেন, ‘আমরা লেখাপড়া বেশি জানি না। বাংলা লিখলে না হয় বানান করে পড়তে পারতাম। ইংলিশে লিখছে, সেগুলো তো পড়তে পারি নাই। ভিসা আসল নাকি নকল, আমরা ক্যামনে জানব?’