রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধাঞ্জলিতে নবীগঞ্জে নিজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রবের জানাজা অনুষ্ঠিত
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ অক্টোবর ২০১৬, ৯:১৩ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুর নিজ এলাকায় বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সাব সেক্টর কমান্ডার ও সাবেক সাংসদ মাহবুবুর রব সাদীর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সোমবার (১৭ অক্টোবর) বেলা ৩টায় নবীগঞ্জ শহরের জে কে হাই স্কুল সরকারী মাঠে প্রথম জানাযা এবং বিকাল ৪.৪৫ মিনিটে দিনারপুর সাতাইহাল ফুটবল মাঠে দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। তারপর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায় ইউনাইটে হাসপাতালের হিমাগারে। বেলা ৩টায় নবীগঞ্জ শহরের জে কে হাই স্কুল সরকারী মাঠে প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং বিকাল ৪.৪৫ মিনিটে দিনারপুর সাতাইহাল ফুটবল মাঠে দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে তাকে গার্ড অব অনার দেয় বাংলাদেশ পুলিশ।
জানাজা শেষে তার লাশ ঢাকায় ইউনাইটে হাসপাতালের হিমাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জানাজা শেষে তাকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে বলে জানা গেছে।
শারিরিক সমস্যা নিয়ে তিন দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ছিলেন মাহবুবুর রব সাদী। রোববার চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার হার্ট অ্যাটাক হয়। এরপর চিকিৎসকরা তাকে আইসিইউতে নেয়ার পরামর্শ দেন। সেখানেই রোববার দিবাগত রাত আড়াইটায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রব সাদীর মুত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে নবীগঞ্জ-বাহুবলে। এই এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য সাদী ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে।
পৃথক জানাজার নামাজে উস্থিত ছিলেন, স্থানীয় সাংসদ এম এ মুনিম চৌধুরী বাবু, সাবেক এমপি আব্দুল মোছাব্বির, জেলা পরিষদের প্রসাশক ডাঃ মুশফিক হোসেন চৌধুরী, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুর উদ্দিন বীর প্রতিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজল মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা আ,খ,ম ফখরুল ইসলাম, আওয়ামীলীগ নেতা শাহ্ নেওয়াজ মিলাদ গাজী, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট আলমগীর চৌধুরী, পৌর মেয়র আলহাজ্ব ছাবির আহমেদ চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাজিনা সারোয়ার, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জীতেন্দ্র কুমার নাথ, উপজেলা জাসদের সভাপতি আব্দুর রউপ, পৌরসভার সাবেক মেয়র ও নবীগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ইমদাদুর রহমান মুকুল, সাধারন সম্পাদক সাইফুল জাহান চৌধুরী, বিএনপির সাধারন সম্পাদক মুজিবুর রহমান সেফু, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কাজী ওয়াবাদুর কাদের হেলাল, আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ মিলু, নবীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন মিঠু, জাপার সভাপতি শাহ্ আবুল খায়ের, উপজেলা যুবলীগের আহব্বায়ক আলহাজ্ব ফজলুল হক চৌধুরী সেলিম, যুগ্ম আহব্বায়ক লোখমান আহমদ খাঁন, সদর ইউপি চেয়ারম্যান জাবেদুল আলম চৌধুরী সাজু, আউশকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান হারুন, পৌরসভার প্যানেল মেয়র এটিএম সালাম, মুহিবুর রহমান চৌধুরী, নবীগঞ্জ কেন্দ্রিয় সাহিত্য সংসদের ভাইস প্রেসিন্টে সাংবাদিক এম, মুজিবুর রহমান, সাধারন সম্পাধক মাওঃ আব্দুর রকিব হক্কানী, সাংবাদিক আকিকুর রহমান সেলিম, আমিনুর রহমান সুমন, ইকবাল আহমদ বেলাল, অহি দেওয়ান চৌধুরী, উজ্জল আলী সরদার, অলিউর রহমান অলি প্রমূখ।
এছাড়াও গভীর শোক প্রকাশ করেন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নাজমা বেগম সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংবাদিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংঘটনের নেত্ববৃন্দ। গার্ড অব অনার শেষে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নবীগঞ্জ উপজেলা কমান্ড, উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা আওয়ামীলীগ, উপজেলা জাসদ, আনন্দ নিকেতন। এছাড়া বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ হবিগঞ্জ জেলা ইউনিট কমান্ড, মৌলভীবাজার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ইউনিট ও নবীগঞ্জ গজনাইপুর ইউপি ও পরগনার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি, আউশকান্দি ইউপি পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়া হয়।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৪৫ সালের ১০ মে উপজেলার বনগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহন করেন।তাঁর বাবার নাম দেওয়ান মোহাম্মদ মামুন চৌধুরী এবং মায়ের নাম সৈয়দা জেবুন্নেছা চৌধুরানী। তাঁর স্ত্রীর নাম তাজকেরা সাদী।
তার বাবা দেওয়ান মোহাম্মদ মামুন চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩দিন পাকবাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন।
ষাটের দশকে ছাত্রাবস্থায় তিনি সিলেট ও মৌলভীবাজারে পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগের একজন সাহসী নিষ্ঠাবান নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়ে ছিলেন। তিনি মৌলভীবাজার ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন।
দেওয়ান মাহবুবুর রব সাদী মুক্তিযুদ্ধে ৪নং সেক্টরের জালালপুর উপ-সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন। তার নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ পরিচালিত হয়। এর মধ্যে কানাইঘাট থানা আক্রমণ অন্যতম।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে একদিন বাংলাদেশের ভেতরে প্রাথমিক অবস্থান থেকে মাহবুবুর রব সাদীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রওনা হয়ে ছিলেন লক্ষ্যস্থলে। চা-বাগানের পথ দিয়ে তাঁরা কানাইঘাট যান। সবাই ছিলো গভীর ঘুমে আর পুলিশও জেগে ছিল না কেউ। শুধু দুজন সেন্ট্রি জেগে ছিল। আক্রমণের আগে সাদী চেষ্টা করেন সেন্ট্রিকে কৌশলে নিরস্ত্র করে পুলিশদের আত্মসমর্পণ করাতে। এ দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধেই নেন। একজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে তিনি থানায় যান। বাকি সবাই আড়ালে তাঁর সংকেতের অপেক্ষায়। সাদী থানার সামনে গিয়ে দেখেন, সেন্ট্রি দুজন ভেতরে চলে গেছে তাই তিনি আড়ালে অপেক্ষায় থাকেন। একসময় একজন সেন্ট্রি বেরিয়ে আসে এবং তাঁদের দেখে চমকে ওঠে, আচমকা ভূত দেখার মতো অবস্থা। সাদী মনে করেছিলেন, সেন্ট্রি ভয়ে পেয়ে আত্মসমর্পণ করবে কিন্তু সে তা না করে তাঁর দিকে অস্ত্র তাক করে। তখন সাদীও তাঁর অস্ত্র সেন্ট্রির দিকে তাক করেন। কিন্তু এর আগেই সেন্ট্রি গুলি করে। ভাগ্যক্রমে রক্ষা পান তিনি। কেবল তাঁর মাথার ঝাকড়া চুলের একগুচ্ছ চুল উড়ে যায়। গুলির শব্দে ঘুমন্ত পুলিশরা জেগে ওঠে এবং দ্রুত তৈরি হয়ে গুলি শুরু করে। এদিকে সাদীর সহযোদ্ধারাও সংকেতের অপেক্ষা না করে গুলি শুরু করেন। ফলে সাদী ও তাঁর সঙ্গে থাকা সহযোদ্ধা ক্রসফায়ারের মধ্যে পড়ে যান। তাঁদের মাথার ওপর দিয়ে ছুটে যায় অসংখ্য গুলি। অনেক কষ্টে তাঁরা থানার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। পরে তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালান।
এ মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিক সাদী মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য ‘বীর প্রতীক’ উপাধিপ্রাপ্ত হন কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। পদ বর্জনের ব্যাপারে তাঁর পরিবার সূত্রে জানা যায়, সাধারণ মানুষজন নিজের জীবন বাজী রেখে পরিবার পরিজন বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়ে যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে তার উপরে আর কোন বীরত্ব হতেই পারে না। এছাড়াও পেশাজীবী সামরিক বাহিনীর সৈনিক না হয়েও বহু মুক্তিযোদ্ধা চরম বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছে তাদের কেনো বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেয়া হবে না; এই একটিমাত্র কারণে তিনি তার ‘বীর প্রতীক’ উপাধি গ্রহণ করেননি।