দেশজুড়ে আলোচিত এমসি কলেজ : একের পর এক সংঘাত-সহিংসতায় সম্পৃক্ত বহিরাগতরা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ অক্টোবর ২০১৬, ৩:০৩ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সিলেট মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজ। আয়তনের দিক থেকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কলেজও এটি। এই অঞ্চলের শিক্ষার প্রসারে সুদীর্ঘকাল থেকেই অবদান রেখে আসছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য এ প্রতিষ্ঠান। তবে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক নেতিবাচক সংবাদের দেশজুড়ে আলোচিত হচ্ছে এমসি কলেজ।
শতবছরের পুরনো ছাত্র হল পুড়িয়ে দেওয়া, ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীন সংঘাত আর অতিসাম্প্রতিক কলেজ ক্যাম্পাসেই খাদিজা বেগম নার্গিসকে কোপানোর ঘটনায় সমালোচিত হচ্ছে এমসি কলেজ। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রকাশ্যে ছাত্রীকে কোপানোর ঘটনায় প্রশ্ন ওঠেছে এই কলেজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হলে অগ্নিসংযোগ থেকে খাদিজাকে কোপানো- সাম্প্রতিক প্রতিটি সহিংস ঘটনার সাথেই সম্পৃক্ত বহিরাগতরা। কলেজ ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা না যাওয়ায়ই একের পর এক সহিংস ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন এই কলেজটির শিক্ষার্থীরা। খাদিজা বেগমকে কোপানো বদরুল আলমও সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বহিরাগত ছাত্র কি করে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে এই নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
২০১২ সালের ৮ জুলাই শিবিরের সাথে সংঘর্ষের জেরে পেট্রোল ঢেলে এমসি কলেজের শতবর্ষী ছাত্রাবাসে আগুন ধরিয়ে দেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এতে ছাত্রাবাসের তিনটি ব্লকের ৪২টি কক্ষ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্থ হয় আরোও ৭০টি কক্ষ।
এই ঘটনার ছবি দেখে কলেজ কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে অগ্নিসংযোগকারীদের বেশিরভাগই কলেজের শিক্ষার্থী নয়। বহিরাগত ক্যাডার। এছাড়া গত তিন বছরে এমসি কলেজে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীন বিরোধে অন্তত পাঁচটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়াও দেওয়া হয়। এসব সংঘর্ষেও নেতৃত্বদানকারীরা এই কলেজের ছাত্র নন। পাশ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রুপের রাজনৈতিক কর্মী।
সর্বশেষ গত ৩ অক্টোবর বিকেলে এমসি কলেজে সিলেট মহিলা কলেজের ছাত্রী কোপানো বদরুল্ও বহিরাগত।
সংশ্লিস্ট সূত্রে জানা যায়, পাহাড় টিলা বেস্টিত বিশাল ক্যাম্পাস হওয়ায় এই কলেজে বহিরাগতদের সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। মূল ফটকে পুলিশ থাকলেও পেছনের বিভিন্ন ফটক দিয়ে ক্যাম্পাসে বহিরাগতরা ঢুকে পড়ে। এছাড়া রাজনৈাতক প্রভাবেও অনেক সময় বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আর দীর্ঘদিন ধরে শুরু হলেও এখনো শেষ হয়নি সীমানা প্রাচীর নির্মানের কাজ। ফলে আরো অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এমসি কলেজের আভ্যন্তরীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা বহু আগে থেকেই বেশ নাজুক। সাধারণ দিনগুলোতে তো বটেই, এমনকি পাবলিক পরীক্ষার দিনেও ক্যাম্পাসে থাকে বহিরাগতদের অবাধ যাতায়াত। কলেজের মূল প্রবেশপথের বামপাশে সীমানা প্রাচীর থাকলেও ডানপাশ প্রাচীরবিহীন এবং পুরোটাই অরক্ষিত।
এমসি কলেজের শিক্ষার্থী মো. মামুন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ক্যাম্পাসে পাবলিক পরীক্ষার দিনে কয়েকজন পুলিশ দায়িত্বে থাকলেও তারা অনেকটা ‘রিল্যাক্সড মুড’-এ থাকেন। মূল ফটকে না থেকে তারা বসেন ফটকের ভেতরে ডান পাশের একটি কক্ষে অথবা ফটক থেকে দূরে রাস্তার পাশের যাত্রী ছাউনীতে। কাজেই তাদের পক্ষে ঠিকঠাক দ্বায়িত্ব পালন করা সম্ভবও হয়ে ওঠে না। এছাড়া ক্যাম্পাসের পেছনের গেটে কোনো পুলিশ থাকেন না। তাই যে কেউ চাইলে অস্ত্র নিয়েও ক্যাম্পাসে সহজেই প্রবেশ করতে পারে। এভাবে চলতে থাকলে আরো খারাপ ঘটনা ঘটবে ক্যাম্পাসে।
বহিরাগতদের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ ক্যাম্পাসে সক্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতারাও। এমসি কলেজ শাখার ছাত্রলীগ নেতা টিটু চৌধুরী বলেন, সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাহীনতার ব্যাপারটি হলো ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা প্রাচীর না থাকা। কেউ কাউকে খুন করে সহজেই কেউ ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যেতে পারবে। অথচ আমরা বহু আগে থেকেই ক্যাম্পাসে সীমানা প্রাচীর দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছি। শুনেছিলাম বহুদিন আগে এর জন্য বাজেটও বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু এখনো ক্যাম্পাসের পুরোটা জুড়ে সীমানা প্রাচীর দেয়া হয়নি।
ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, এমসি কলেজের ডানপাশের অরক্ষিত জায়গাটিতে সীমানা প্রাচীর দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। এটি নির্মাণ শেষ হতে আরো মাসখানেক সময় লেগে যাবে বলে জানান নির্মাণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা। তবে সেই সীমানা প্রাচীর দেয়া হচ্ছে কেবল ফটকের বাইরের প্রধান সড়কের পাশ জুড়ে। এরপরেও কলেজের পূর্ব পাশের বড় একটা অংশ আর ছোট ফটকের পাশের অংশটি রয়ে গেছে প্রাচীরবিহীন।
এ ব্যাপারে এমসি কলেজের অধ্যক্ষ নিতাই চন্দ্র চন্দ বলেন, “কলেজের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা বজায় রাখতে আমরা সবসময় সচেষ্ট। অতি সম্প্রতি এক বহিরাগত কর্তৃক নৃশংস হামলার ঘটনাটির পরে আমরা পুলিশের কাছে বাড়তি নিরাপত্তার আবেদন জানিয়েছি।
তিনি বলেন, পুলিশ প্রহরা শুধুমাত্র প্রধান ফটকে দেয়া হয়, তাই ক্যাম্পাসের পেছন দিকের ছোট গেটটি অরক্ষিত থেকে যায়। তালা দিয়ে রাখার পরও বহিরাগত কেউ সেদিক দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারে। আমরা চেষ্টা করছি বহিরাগতদের এমন প্রবেশ ঠেকানোর ব্যবস্থা নেয়ার।
সীমানা প্রাচীর না থাকা প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ বলেন, মন্ত্রনালয় থেকে কিছু বরাদ্দ আসায় আমরা একটা অংশের সীমানা প্রাচীর তৈরির কাজ শুরু করেছি। এটি শেষ হতে আরো এক মাস সময় লেগে যাবে। আর বাজেট বরাদ্দ সাপেক্ষে পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসের বাকি অরক্ষিত অংশেও সীমানা প্রাচীরের কাজ শুরু করতে পারবো বলে আমি আশাবাদী।
উল্লেখ্য, গত সোমবার (৩ অক্টোবর) বিকেলে খাদিজা আক্তার নার্গিসকে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করে বদরুল আলম নামের এক শাবি ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা। গুরুতর আহত খাদিজাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সোমবার মধ্যরাতেই ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। খাদিজা বর্তমানে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে আছেন।
এ ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা হামলাকারী বদরুলকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। খাদিজার চাচা বাদি হয়ে বদরুলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার পর বর্তমানে বদরুল কারাগারে রয়েছে।