লাফ দিয়ে পার হওয়া যাবে বাসিয়া নদী!
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ অক্টোবর ২০১৬, ২:০৫ অপরাহ্ণ
কালের স্বাক্ষী সুরমা নদীতে যার উৎসমুখ সেই সুরমা নদীর মাসুকগঞ্জ বাজারের কাছ থেকে কামাল বাজার মুন্সীর বাজার লালাবাজার হয়ে বিশ্বনাথের বুক চিরে যে দৃষ্টিনন্দন নদীটি প্রবাহিত হয়েছে সেই ঐতিহ্যবাহী নদীর নাম বাসিয়া নদী। এককালে এই নদীতেই পাল তোলা নৌকা চলতো পত পত করে, হাওয়ার তালে তালে। মাঝিরা গুন টেনে, দাঁড় টেনে আবার কখনওবা ভাটিয়ালি সুরে গান গেয়ে গেয়ে নৌকা দিয়ে পরিবহন করতো মালামাল কিংবা যাত্রী সাধারনকে। বর্ষা মৌসুমে হতো নৌকা বাইচ। বর কনের নৌকা চলতো বিভিন্ন সাঁজে রঙে ঢঙে। নদীর বিভিন্ন স্থানে বড় বড় ডর (মোহনা) ছিল। ডরগুলোতে কন্যা নৌশা ও বরযাত্রীদের নৌকা পানির নিচে তলিয়ে যাবার গল্পও শোনা যেতো। অনেকে বলতেন নয়া কন্যা নউশাকে মাত্তা বা দেওলায় নিয়ে যেতো। বড় ও গভীর খরস্রোতা নদীতে নাকি মাত্তা বা দেওলা থাকতো।
আবার বড় বড় লঞ্চ ষ্টিমার দাঁপিয়ে বেড়াতো এই বাসিয়া নদী দিয়ে। বাসিয়া নদী নিয়ে অনেক কবিতা গানও রচনা করেছেন অনেক কবি সাহিত্যিক গীতিকারেরা। বর্তমানে এই ঐতিহ্যবাহী বাসিয়া নদীতে ডর (মোহনা) নেই, কথিত মাত্তা কিংবা দেওলাও নেই, পাল তোলা নৌকা নেই, গুণ বা দাড় টানার চমৎকার দৃশ্য নেই, প্রচন্ড বেগের স্্েরাত নেই, লঞ্চ বা স্টিমারের দাপাদাপি নেই। যেন নির্জীব একটি মরা খালে পরিণত হয়েছে বিশ্বনাথের প্রাণ বাসিয়া। এই কদিন পুর্বেও যে খরস্রোতা বাসিয়া নদীর পরিধি ছিল তার এক চতুর্তাংশও এখন আর অবশিষ্ট নেই। বিশ্বনাথের গরু হাঠার পার্শ্বে যে বিশাল ডর ছিল তা ভরাট হয়ে ডরের উপর এখন বাসা বাড়ি দোকান পাঠ ও কলোনি নির্মিত হয়েছে। বিশ্বনাথ বাজারের কিছুটা পূর্ব দিকে রজকপুরের ডরের পার্শ্বে খেয়া নৌকায় উঠতে বুক ধুরু ধুরু করতো। আরও বিভিন্ন জায়গায় ছিল অনেকগুলি ডর। কিন্তু এখন আর ডরতো নেইই বরং তা ভরাট হয়ে পরিণত হয়েছে ক্ষেতের জমিন, দোকান পাঠ, কলোনি ও বাসা বাড়িতে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই ঐতিহ্যবাহী বাসিয়া নদী একটি ছড়া বা নালায় পরিণত হবে যা অনায়াসে পার হওয়া যাবে লাফ দিয়ে!
অনুসন্ধানে জানা গেছে বাসিয়া নদীর উৎসমুখ এতই সংকুচিত হয়ে পড়েছে যে সুরমা নদী থেকে পানির প্রবাহ প্রায় বন্ধই বলা চলে। ফলে উৎসমুখ থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার নদী বর্তমানে প্রায় বিলীন হয়ে অবৈধ দখলদারদের ক্ষেতের জমীতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া ভুমিখেকো দখলদাররা অবাধে দখল করে নির্মাণ করছে দোকান গৃহ মার্কেট কিংবা ঘর বাড়ী বাসা মার্কেট দোকানকোঠা কলোনিসহ অবৈধ স্থাপনা। দিন দিন নদীতে পলি জমে ভরাট হলেও কারো মাথাব্যথা নেই। বরং দখলদাররাই হচ্ছে দিন দিন আঙুল ফুলে কলাগাছ কিংবা বটগাছ। বাসিয়া নদী বিলীন হতে থাকায় অনেক দেশীয় প্রজাতির মিঠা পানির মাছের দেখাও আর পাওয়া যায় না। বিলীন হচ্ছে আমাদের মুল্যবান মৎস্য সম্পদও। এছাড়া বাসিয়া নদী থেকে উৎপন্ন হওয়া বিখ্যাত চরচন্ডী নদীসহ বিভিন্ন শাখানদীও ক্রমান্বয়ে বিলীন হয়ে গেছে।
বাসিয়া নদী খনন প্রসঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব শফিকুর রহমান চৌধুরীর সাথে এ প্রতিবেদকের আলাপ হলে তিনি বলেন অচিরেই বাসিয়া নদী খনন করা হবে। তিনি আরও বলেন নদীতে পানি থাকলে মাছ হবে। পানি দিয়ে কৃষি জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হবে। ফলে ধান ও শাক সবজির ফলন বৃদ্ধি পাবে। তাই নদী খনন জরুরী হয়ে পড়েছে। বাসিয়া নদী খনন করে বিশ্বনাথবাসীকে অকাল বন্যার হাত থেকে রক্ষাসহ হারিয়ে যাওয়া নদীটির নাব্যতা ফিরিয়ে আনা এখন বিশ্বনাথবাসীর প্রাণের দাবী।
রিপোর্টটি করেছিলাম প্রায় সাত বছর পূর্বে। তখন জাতীয় স্থানীয় দেশি বিদেশী বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় রিপোর্টটি ফলাও করে ছাঁপা হয়েছিল। এর কিছুদিন পর ৭১ এর বীর মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত সন্তানদের সংগঠন ‘মুক্তিযোদ্ধার প্রজন্ম’র পক্ষ থেকে তৎকালীণ এম.পি আলহাজ্ব শফিকুর রহমান চৌধুরীর কাছে বাসিয়া নদীর উৎসমুখ থেকে শুরু করে পুরো নদীটি খননের দাবীতে বিশ্বনাথবাসীর পক্ষ থেকে একটি স্মারকলিপি প্রদান করি। দাবীটির প্রতি একাত্মতা পোষন করে স্মারকলিপি প্রদানকালে আমাদের সাথে গিয়েছিলেন বিশ্বনাথের ব্যবসায়ীমহলসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। সংসদ সদস্য খুবই আন্তরিকতার সাথে আমাদের দেয়া স্মারকলিপিটি গ্রহণ করেন। সেসাথে আমাদেরকে পরামর্শ দেন যে, জরুরি ভিত্তিতে বাসিয়া নদী খননের জন্য বরাদ্ধ চেয়ে আমি স্মারকলিপিটিতে একটি সুপারিশ লিখে দিতেছি এখনই। আপনারা সংগঠনের পক্ষ থেকে কপিটি পানি উন্নয়ন বোর্ডে জমা দিয়ে দিবেন। বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে দেখার জন্য আমি ফোন করেও তাদেরকে বলে দেবো। আমরা মুক্তিযোদ্ধার প্রজন্ম’র পক্ষ থেকে স্মারকলিপিটি জরুরি ভিত্তিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডে জমা দেই। পরবর্তীতে জানা গেল বাসিয়া নদীর উৎসমুখ থেকে শুরু করে বিশ্বনাথ বাজারের বাসিয়া সেতু পর্যন্ত নদীটি খননের জন্য কোটি টাকারও উপরে বিশাল বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে অনেক প্রতিক্ষার পর অবশেষে শুরু হলো ড্রেজিংয়ের কাজ। কিন্তু কাজ শুরুর সুচনাতেই ড্রেজিং কাজে নানা অনিয়মের পাওয়া গেলো বিস্তর অভিযোগ। অনেক লেখালেখিও হলো মিডিয়াতে।
বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সে সময় সিলেট-২ আসনে নতুন এম.পির দায়িত্ব গ্রহণ করেন জাতীয় পার্টির তরুন নেতা ইয়াহইয়া চৌধুরী এহিয়া। একদিন এম.পি মহোদয় হঠাৎ আমাকে ফোন করে জানালেন, বাসিয়া নদী খননের জন্য বিশাল বরাদ্ধ এসেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছুই হচ্ছেনা বলে অভিযোগ আসছে। লোক দেখানো দায়সারা গোছের কাজ করছে কন্ট্রাক্টররা এমন অভিযোগ করছেন সচেতন মহল। আপনারা এ ব্যাপারে আরও লেখালেখি এবং স্বোচ্ছার ভুমিকা পালন করলে কিছুটা কাজ হতে পারে।
আমি বললাম আমাদের আন্দোলন ও স্মারকলিপি প্রদানের ফলেই এ বিশাল বরাদ্ধ এসেছে। বরাদ্ধ পরিমাণ কাজ না হলে আমরা লেখালেখি ও আন্দোলন চালিয়ে যাবো। তিনি বললেন আমি আগামী কাল উপজেলা পরিষদের সামনে নদী খনন পরিদর্শনে আসবো। কন্ট্রাক্টরকেও উপস্থিত থাকার জন্য বলেছি। আপনারা থাকলে আরও ভালো হবে। আপনারা লেখালেখি ও আন্দোলন করলে আমরা এ ব্যাপারে কথা বলতে কিছুটা ভর পাবো। নির্দিষ্ট সময়ে এম.পি মহোদয় উপস্থিত হলেন। সেসময় স্থানীয় সাংবাদিকসহ সচেতন অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। সেসময় সচেতন অনেকেই খনন কাজে অনিয়মের বিষয়টি তুলে ধরলেন। এম.পি মহোদয়ও খনন কাজে নিয়োজিতদের সঠিকভাবে কাজ করার জন্য তাগিদ দিলেন ও অনিয়মের নিদর্শনগুলি সরেজমিন দেখিয়ে দিলেন। খনন কাজে অনিয়মের বিরুদ্ধে সচেতন বিশ্বনাথবাসী এমনকি কৃষকদের পক্ষ থেকেও হলো আন্দোলন, মানবন্ধন, লেখালেখি।
এর পুর্বে বিশ্বনাথ বাজারের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাসিয়া নদীর উভয় তীরের শুধুমাত্র ঘাস ছিড়ে তাদের কার্য সমাধা করেছিল। আন্দোলনের পরে কিছু কিছু জায়গায় আলতো করে সামান্য মাটি চেছেই কার্য সমাধা হয়েছে বলে সমাপ্তি দিলো।
বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আমাদের কাছে খবর আসতে লাগলো যে, টুকটাক লোকদেখানো উপরি খনন করে অসাধু ঠিকাদাররা জনগনের ট্যাক্সের বিশাল অর্থতো হাতিয়ে নিচ্ছেই, পাশাপাশি বিশ্বনাথ বাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় খনন না করার জন্যও নাকি অনেক ভুমিখেকোরা ঠিকাদারদেরকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়েছে। এজন্য ঠিকাদারদের লাভ হয়েছে ডাবল। খননকাজে এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের সঠিক তদন্ত চান সচেতন বিশ্বনাথবাসী। আগামীতেও বাসিয়া নদী খনন প্রকল্পের কাজে এ ধরনের লুটপাট হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল। এ ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে সকলকে। স্বোচ্ছার ভুমিকা পালন করতে হবে সচেতন বিশ্বনাথবাসীকেই।
বিশ্বনাথের প্রাণ বাসিয়া নদী রক্ষার জন্য সকলেই একমত। আন্দোলনও চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় তরুন নাট্যকার ফজল খান ‘বাঁচাও বাসিয়া ঐক্য পরিষদ’ গঠন করে একঝাঁক তরুনকে সাথে নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে আন্দোলন সংগ্রাম। পালন করেছে বিভিন্ন কর্মসূচি। আমার সংগঠন মুক্তিযোদ্ধার প্রজন্ম’র পক্ষ থেকে বিশ্বনাথের প্রাণ বাসিয়া নদীকে বাঁচাতে এবং বিশ্বনাথবাসীকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে সকলের সকল আন্দোলন সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানাই। পাশাপাশি দল মত নির্বিশেষে সকলকে আরও স্বোচ্ছার ভুমিকা পালনের জন্য জানাই বিনীত অনুরোধ। কারন বাসিয়া নদীটি বিলুপ্ত হলে শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যাবেনা। বোরো ও সবজি চাষে নেমে আসবে চরম বিপর্যয়। আর বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি আটকে থেকে সৃষ্টি হবে জলাবদ্ধতার। সর্বোপরি আমাদের পরিবেশের উপর পড়বে বিরূপ প্রভাব। হারিয়ে যাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। জীববৈচিত্র হতে থাকবে বিলুপ্ত।
লেখক: নাজমুল ইসলাম মকবুল
সভাপতি, সিলেট লেখক ফোরাম