ছোট্ট একটি উদ্যোগেই কমে গেছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ৬০ ভাগ প্রাণহানি
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১:১১ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কটি পৃথিবীর প্রাণঘাতী মহাসড়কগুলোর একটি। এই মহাসড়কে বাসস্টপ ও গতিরোধকের মতো সড়ক নিরাপত্তার মৌলিক কিছু অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নেওয়া হয় একটি পাইলট প্রকল্প। আর এতেই বদলে যায় এই মহাসড়কের প্রাণঘাতী রূপ। প্রথম বছরেই এই মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার ৬০ শতাংশের বেশি হ্রাস পায়। এই তথ্য মিলেছে একটি গবেষণায়।
বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমাতে কাজ করা নেদারল্যান্ডসের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেফ ক্রসিংসের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, এসব নিরাপত্তামূলক উদ্যোগের ফলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ তিনটি স্থানে মৃত্যুর হার কমেছে। আগে যেখানে গড় মৃত্যুর হার ছিল ১১০, সড়ক নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার পর সেখানে এই সংখ্যা কমে হয়েছে ৪২।
সেফ ক্রসিংসের হিসাবমতে, এই মহাসড়কে মৃত্যুর সংখ্যা ১২ থেকে কমে ৩ হয়েছে। আহত হওয়ার সংখ্যা ২৪০ থেকে ৭৭-এ নেমেছে। জরিপে অংশ নেওয়া স্থানীয় জনগণের প্রায় শতভাগই বলছেন, মহাসড়কটি আগের চেয়ে নিরাপদ হয়েছে।
সেফ ক্রসিংসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসপার ভেত বলেন, ‘এই ফলাফল সরকার, ব্যাংক ও উন্নয়ন দাতাদের এই বার্তা দেয় যে সড়ক নিরাপত্তার জন্য ছোট ছোট কিছু বিনিয়োগ প্রতিবছর শত শত মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। আমরা কোনো ব্যবস্থা নিই না বলেই এই মানুষগুলো সড়কে বিনা কারণে প্রাণ হারাচ্ছে, প্রিয়জনকে হারিয়ে পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, গুরুতর আহত অবস্থা বা প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছে। অথচ এই ফলাফল দেখলে এগুলো মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।’ এই মহাসড়কে প্রতিবছর শত শত মানুষ মারা যায়। আহত হয় হাজার হাজার মানুষ। ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে উচ্চগতির এই মহাসড়ক সংস্কারের পর হতাহত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ সরকারের ২০১২ সালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বছরে ১৮০ জন নিহত হয়। তবে এই পরিসংখ্যান নিয়ে সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ আছে। তাঁরা মনে করেন, প্রকৃত সংখ্যা এর প্রায় চার গুণ।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের এই হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের দুর্ঘটনার চিত্রই তুলে ধরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে, প্রতিবছর বাংলাদেশে ২১ হাজারের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। এতে ক্ষতির পরিমাণ দেশটির জিডিপির ১ দশমিক ৬ শতাংশ।
বেপরোয়া গাড়ি চালানো, ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন এবং পদচারী-সেতু, গতিরোধক ও সড়ক বিভাজকের মতো সড়ক নিরাপত্তার মৌলিক অবকাঠামোর ঘাটতিকে দুর্ঘটনার বড় কারণ হিসেবে দেখা হয়। তবে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি বিশ্বব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত থাকে না কিংবা সরকারও এ ব্যাপারে নজর দেয় না।
ইয়াসপার ভেত বলেন, ‘সাইকেল, রিকশা বা বাসের যাত্রী, মহাসড়ক দিয়ে চলা পথচারী, কাজ বা বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য বের হওয়া পথচারী—যাঁদের আমরা ঝুঁকির মুখে থাকা সড়ক ব্যবহারকারী বলি, উচ্চগতির এই মহাসড়কে বিপজ্জনক যানবাহন থেকে তাঁদের সুরক্ষার জন্য কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেই। সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত তথ্য না থাকা এবং দুর্ঘটনা ও সড়ক নিরাপত্তার মধ্যে যোগসূত্রের বিষয়টি জানা না থাকায় সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে মৌলিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো বাদ দেওয়া হয়। মনে করা হয়, এগুলো প্রকল্পের বাড়তি খরচ।’
সেফ ক্রসিংস ২০১৪ সালে সেন্টার ফর ইনজুরি, প্রিভেনশন, হেলথ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চের (সিআইপিআরবি) সঙ্গে মিলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ তিনটি স্থানে সড়ক নিরাপত্তার কাজ শুরু করে। এই মহাসড়ক ব্যবহার করেন এবং এর আশপাশে থাকেন এমন মানুষদের ওপর জরিপ পরিচালনা করে সেফ ক্রসিংস সবচেয়ে বেশি মানুষ হতাহত হওয়ার দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গাগুলো চিহ্নিত করে। এই মহাসড়কে অবকাঠামোগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিষ্ঠানটি সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী এবং সরকারের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করার একটি পরিকল্পনা তৈরি করে।
সেফ ক্রসিংস মহাসড়কের কিছু স্থানে রাম্বল স্ট্রিপ নির্মাণ করে, যাতে চালকেরা বুঝতে পারেন তাঁরা গ্রামের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সড়কে ঢুকছেন এবং তাঁদের গাড়ির গতি কমাতে হবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে গতিরোধক। যেসব স্থান দিয়ে লোকজন বেশি রাস্তা পার হয়, সেখানে আঁকা হয়েছে পথচারী পারাপারের চিহ্ন। মহাসড়কের যত্রতত্র বাস থামানোর অভ্যাস বন্ধ করতে মহাসড়কের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে বাসস্টপ। এতে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের অন্যতম কারণ পাল্লা দিয়ে যান অতিক্রম করার (ওভারটেকিং) হার কমেছে। গ্রামের কাছাকাছি মহাসড়কের অংশে আলোর প্রতিফলন হয় এমন রেখা টেনে দেওয়া হয়। এটি চালকদের মনে ধারণা দেয়, তাঁদের সামনের রাস্তাটি সংকীর্ণ। তাঁদের গাড়ির গতি কমিয়ে ফেলতে হবে। সেফ ক্রসিংস ও সিআইপিআরবি আশা করছে, এই পাইলট প্রকল্পের ফলাফল বাংলাদেশ সরকারকে বৃহত্তর পরিসরে জাতীয় পর্যায়ে একই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করবে।
অনুবাদ ও ছবি : প্রথম আলো