চিকিৎসকের ভূমিকায় ৩শ স্পেশাল কর্মচারী!
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ৪:৪৪ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজঃ চিকিৎসাসেবায় দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। নানা রোগব্যাধি নিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিনই অসংখ্য রোগী ভর্তি হচ্ছেন এই হাসপাতালটিতে। অথচ সরকারি এই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেক দিন ধরেই। এখানে বহিরাগতদের দৌরাত্ম্য নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক প্রতিবেদন হয়েছে। রোগী ভাগিয়ে কমিশনের বিনিময়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া, ওয়ার্ড থেকে শিশু চুরির মতো ঘটনাও ঘটছে। স্পর্শকাতর সব বিভাগ ও ইউনিট দাবড়ে বেড়াচ্ছেন তারা, যারা হাসপাতালের কর্মচারী পর্যন্ত নন।
সর্বশেষ গত শুক্রবার বিপ্লব ম-ল নামে এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। স্টেথোসকোপ গলায় ঝুলিয়ে বাইরে থেকে আসা এক সুইপার তার চিকিৎসা করছিলেন। এ ঘটনা এখানে নতুন নয়। হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়-সুইপাররাও অহরহই এখানে চিকিৎসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্য হাসপাতালজুড়ে সিসিক্যামেরা লাগানো হয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো ফল আসেনি। বাইরের যারা এখানে বয়, সুইপার ও আয়ার কাজ করেন তাদের বলা হয়ে থাকে ‘স্পেশাল কর্মচারী’। হাসপাতালেরই কর্মচারীদের সঙ্গে মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে এরা এখানে কাজ করে থাকেন। জানা গেছে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এমন স্পেশাল কর্মচারীর সংখ্যা অন্তত ৩শ।
হাসপাতালটির নিজস্ব বা স্পেশাল অনেক কর্মচারীই রোগীর সেলাই করা, ড্রেসিং করা, ক্যাথেটার লাগানো, সাকার মেশিন লাগানো ও অক্সিজেন মাস্ক পরানোসহ স্পর্শকাতর অনেক কাজ করছেন। তারা চিকিৎসক ও নার্সকে সহযোগিতা করতে গিয়ে কিছুদিন পর নিজেরাই চিকিৎসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন।
দেশের বৃহত্তম চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতালটির নিউরোসার্জারি বিভাগের ১০০ নম্বর ওয়ার্ডে দেলোয়ার হোসেন, ইমন, ইয়াসিন, কামাল হোসেন, আমির হোসেন ও জয়নাল আবেদীন নামে ছয়জন বহিরাগত স্পেশাল কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের এক্স-রে, সিটিস্ক্যান ও এমআরআই করানো থেকে শুরু করে চিকিৎসাকালীন চিকিৎসক ও নার্সদের সহযোগিতা করে থাকেন তারা। অনেক সময় তারা রোগীর ড্রেসিং করা, ক্যাথেটার লাগানো, অক্সিজেন মাস্ক পরানোসহ অনেক কাজই করে থাকেন। শুধু নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডেই নয়, তাদের মতো আড়াই থেকে তিনশ বহিরাগত স্পেশাল কর্মচারী পরিচয়ে হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্লক, কেবিন ব্লক, জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ ও নতুন ভবনসহ বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করছেন।
হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বর্তমানে হাসপাতালে ২ হাজার ৩০০ শয্যা রয়েছে। প্রতিদিন হাসপাতালটিতে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার রোগী চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। এসব রোগীর চিকিৎসাসেবা প্রদানে হাসপাতালে ৮৭০ জন কর্মচারী রয়েছেন নিয়োগপ্রাপ্ত বা নিজস্ব। কিন্তু তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার কারণে স্পেশাল কর্মচারীরা মওকা পাচ্ছেন। প্রতিদিন চব্বিশ ঘণ্টা তিন শিফটে হাসপাতালটিতে পালাক্রমে অন্তত ৩০০ বহিরাগত স্পেশাল কর্মচারী পরিচয়ে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও ইউনিট দাবড়ে বেড়াচ্ছেন। তারা রোগীদের খাবার এনে দেওয়া, বিছানাপত্র ঠিক করা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীকে শয্যাসহ আনা-নেওয়া করা ও রোগীর ব্যবস্থাপত্রাদি নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসা-যাওয়া করাসহ নানা ধরনের কাজ করে থাকেন। এসব কাজের পাশাপাশি তারা রোগীর ড্রেসিং করা, ক্যাথেটার লাগানো, অক্সিজেন মাস্ক পরানোসহ আরও কিছু জটিল কাজও করে থাকেন। আর এসব কাজের বিনিময়ে তারা রোগী বা রোগীর স্বজন থেকে সহানুভূতি হিসেবে আবার কখনো কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেন। সুযোগ পেলে রোগীদের টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোনসেটসহ প্রয়োজনীয় মালামাল চুরি, হাসপাতালের ওষুধ চুরি, শিশু চুরি ও কৌশলে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে এসব স্পেশাল কর্মচারীর বিরুদ্ধে। এমন অনেক স্পেশাল কর্মচারী আছেন যারা এখানে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছেন।
হাসপাতালটিতে কিছুদিন পর পরই নবজাতক চুরির ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ গত ২২ সেপ্টেম্বর বিকালে হাসপাতালের ২০০ নম্বর ওয়ার্ড থেকে চুরি হয়েছে তিন মাস বয়সী শিশু খাদিজা। এ ঘটনায়ও হাসপাতালের স্পেশাল কর্মচারীরা জড়িত বলে জোর অভিযোগ রয়েছে। এতে হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক ডা. মোজাম্মেল হককে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে গতকাল শনিবার।
গত শুক্রবার বিপ্লব ম-লের মৃত্যুর ঘটনায়ও হাসপাতালের উপপরিচালক খাজা আবদুল গফুরকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেনÑ সহকারী পরিচালক ডা. মোজাম্মেল হোসেন ও আরএস (জেনারেল) মাজবুব এলাহী। কমিটিকে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া প্রতিদিন হাসপাতালটি থেকে রোগী ও তার স্বজনদের টাকা-পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল ফোনসেট, হাসপাতালে বিনামূল্যে বিতরণকৃত ওষুধ ও খাবারও চুরি হচ্ছে অহরহই। হাসপাতালের এসব অপরাধজনক কর্মকা- বন্ধের জন্য হাসপাতালে সিসিক্যামেরা স্থাপন ও আনসার মোতায়েন করা হলেও অপরাধজনক কার্যকলাপ বন্ধ হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে সকাল, বিকাল ও রাতÑ এই তিন শিফটে সাতজন করে মোট ২১ কর্মচারী দায়িত্ব পালন করেন। এসব কর্মচারীর সঙ্গে তিন শিফটে ৩৫ জন স্পেশাল কর্মচারী ডিউটি করেন।
জরুরি বিভাগের মতো স্পেশাল কর্মচারীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। বার্ন ইউনিটে তিন শিফটে ২০ জনের বেশি স্পেশাল কর্মচারী ডিউটি করেন। বার্ন ইউনিটের একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব কর্মচারী মূলত চিকিৎসকদের নিজস্ব। চিকিৎসকরাই স্পেশাল কর্মচারীদের কাজের সুযোগ দিয়েছেন।
হাসপাতালের কেবিন ব্লকের দায়িত্বে রয়েছেন ওয়ার্ড মাস্টার বাবুল মিয়া। কেবিন ব্লকে দায়িত্বরত হাসপাতালের নিজস্ব কর্মচারীদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় না। এ কারণে কেবিন ব্লকে থাকা কক্ষগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে সেখানে ১৫ থেকে ২০ জন স্পেশাল কর্মচারী কাজ করেন। এসব স্পেশাল কর্মচারী রোগীর অনেক রকম সেবা প্রদানের সঙ্গে জড়িত।
হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার ২০৪ নম্বর থেকে ২২০ নম্বর রুমের দায়িত্বে রয়েছেন ওয়ার্ড মাস্টার জিল্লুর রহমান। এসব ওয়ার্ডে হাসপাতালের নিজস্ব কর্মচারীর পাশাপাশি স্পেশাল কর্মচারীও রয়েছেন।
হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্লক, ১০৫ থেকে ১১৫ নম্বর ওয়ার্ড, কিচেন, নতুন ভবনের নিচতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত দায়িত্বে রয়েছেন ওয়ার্ড মাস্টার শামসুল আলম। তার আওতায় প্রায় অর্ধশত স্পেশাল কর্মচারী দায়িত্ব পালন করেন।
নতুন ভবনের পাঁচতলা থেকে দশতলা পর্যন্ত ওয়ার্ডে, রোগ নির্ণয় কেন্দ্রসহ চিকিৎসকদের কক্ষে দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় ১০০ স্পেশাল কর্মচারী।
হাসপাতালটির বহির্বিভাগের দায়িত্বে আছেন ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজউদ্দিন। সেখানকার স্পেশাল কর্মচারীরা চিকিৎসকের স্বাক্ষর জাল করে ও তার সিলের অনুরূপ সিল ব্যবহার করে সরকারি ওষুধ কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছেন। বহির্বিভাগে স্পেশাল কর্মচারী ছাড়াও দালাল চক্র বেশ সক্রিয়। হাসপাতালে আগত রোগীদের কম খরচে উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান ও রোগ নির্ণয় পরীক্ষার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৩ সালে হাসপাতালটিকে ৮০০ শয্যা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৭০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। সে সময়ও কোনো জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ২০১৩ সালে ১ হাজার ৭০০ শয্যার হাসপাতালটিকে ৬০০ শয্যা বাড়িয়ে ২ হাজার ৩০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু ওই সময়েও জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। হাসপাতালে মোট পদ রয়েছে ২ হাজার ১৭টি। হাসপাতালে আসা রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পদসংখ্যা ৩ হাজার ৩০৩টি করার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠায়। প্রস্তাবটি এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন। প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল না থাকায় চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ব্যক্তিগতভাবে কিছু লোককে হাসপাতালে কাজে সুযোগ করে দেন। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের কর্মচারীরা ডিউটি না করে অলস সময় কাটান। নিজস্ব কর্মচারীরা অনেক সময় হাসপাতালে আসেন না। মাস শেষে বেতন তুলে নেন এমন অভিযোগও মেলে হাসপাতাল ঘুরে।
বহিরাগতদের বিষয়ে হাসপাতালের উপপরিচালক খাজা আবদুল গফুর বলেন, স্পেশাল কর্মচারীদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা হাসপাতাল পরিচালক জানেন। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। তবে বিপ্লব ম-লের মৃত্যুর ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। -আমাদের সময়।