একটি স্বপ্নের মৃত্যু
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ৪:৩৭ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজঃ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েটির স্বপ্ন ছিল, ভালো চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন তাঁর পূরণ হয়নি। স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই তাঁকে খুন করে তাঁর স্বামী। যে ছিল তাঁর প্রেমিক। স্বামী বলেছিলেন, তিনি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু তিনি একজন ‘হোটেল বয়’। খুন হওয়া মেয়েটির নাম ওয়াহিদা সিফাত (২৭)। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করেন। আর ছেলেটির নাম আসিফ (২৭)। তাঁদের তিন বছরের একটি ছেলে রয়েছে। এখন সে নানার জিম্মায় রয়েছে। গত বছরের ২৯ মার্চ রাজশাহীতে শ্বশুরবাড়িতে স্বামী আসিফই সিফাতকে খুন করেছেন বলে আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্র উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন আসিফের বাবা আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন রমজান (৬২), মা নাজমুন নাহার নাজলী (৫৫) এবং সিফাতের মরদেহের প্রথম ময়নাতদন্তকারী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক জুবায়দুর রহমান (৫৪)। আসিফ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। বাকিরা জামিনে। অভিযোগপত্রে বলা হয়, সিফাতকে খুন করা হলেও চিকিৎসক জুবায়দুর প্রতিবেদন দিয়ে বলেছিলেন, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। পরে প্রমাণিত হয় সিফাত আত্মহত্যা করেনি। তাঁকে খুন করা হয়েছে। মামলাটি ঢাকার তিন নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। ইতিমধ্যে এ মামলায় ছয়জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আগামী মঙ্গলবার এই মামলার শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। সিফাতের বাবা ও চাচার সঙ্গে কথা বলে এবং মামলার নথি থেকে জানা যায়, সিফাত ও আসিফ রাজশাহীর একটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে একসঙ্গে পড়তেন। সেখানেই তাদের পরিচয়, প্রেম। সিফাত ভালো ফল করেন। ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। আসিফ ভালো ফল করতে না পারায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি। চলে যান লন্ডনে। সিফাতের কাছে আসিফ দাবি করেছিলেন, তিনি (আসিফ) লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়ছেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি সেখানে হোটেল বয় হিসেবে চাকরি করেন। এর মধ্যে সিফাত অনার্স পাশ করেন। দেশে এসে ২০১০ সালে আসিফ বিয়ে করেন সিফাতকে। এরপর সিফাতের স্বপ্ন ভঙ্গ শুরু হয়। তিনি জেনে যান, সিফাতের আসল পরিচয়। লন্ডনে তিনি কোনো লেখাপড়াই করেননি। একপর্যায়ে ব্যবসা করবেন বলে বাবার বাড়ি থেকে সিফাতকে ২০ লাখ টাকা এনে দিতে চাপ দেন আসিফ। অন্যদিকে সিফাতকে কোনো চাকরিতে যোগ না দিতে চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু সিফাত চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান। তারপরও সিফাত চাকরির পরীক্ষা দিতে ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ওই দিন রাতেই সিফাতের মাথার পেছনের দিকে সজোরে আঘাত করেন তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করেন আসিফ। অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, হত্যা নিশ্চিত করার পর শুরু হয় আসিফের নাটক। তিনি কক্ষের প্রধান দরজা দিয়ে বের না হয়ে ব্যালকনি দিয়ে বেরিয়ে বাসার বাইরে যান। খুনের তিন ঘণ্টা পর বাসায় এসে সিফাতকে হাসপাতালে নেন। পরে আসিফের বাবা সিফাতের বাবাকে ফোনে বলেন, সিফাত গুরুতর অসুস্থ। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর পাঁচ মিনিট পর ফোন দিয়ে বলে, সিফাত গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর লাশ এখন হাসপাতালের মর্গে। চার ঘণ্টার মধ্যে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে বলেন, আত্মহত্যার কারণে সিফাতের মৃত্যু হয়েছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ৫ থেকে ৭ দিন সময় লাগে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিতে। কিন্তু সিফাতের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে প্রতিবেদন দেন চিকিৎসক জোবায়দুর। তিনি আসামিদের বাঁচানোর জন্য এমন কাজ করেছেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, দেয়াল বা দরজার চৌকিতে সিফাতের মাথার পেছনের অংশকে আঘাত দেওয়া হয়েছে। মাথার পেছনের ওই অংশ অত্যন্ত সংবেদনশীল। যেখানে আঘাত লাগলে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে কোমায় চলে যায়। মানুষের মৃত্যু হয়। সিফাতের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে। অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, ‘আসামি দরজা খুলে দিয়ে দরজার বাইরে অপেক্ষমাণ অন্যের সহায়তা না নিয়ে প্রায় ৫০ থেকে -৫৫ কেজি ওজনের সিফাতকে গলার ওড়নার গিট্টি খুলে একাকী নামিয়ে সোজা করে শোয়ানো, গলায় ফাঁস দিয়ে ওড়নার গিট্টি খুলে দিয়ে সোজা ও স্বাভাবিক করা, ডাইনিং এর চেয়ারটেবিলে সেটিংস করে রাখার পর দরজা খুলে দেওয়ার কাহিনি অযৌক্তিক ও অবিশ্বাস্য ঘটনা।’ অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘অপরাধী যত চালাকই হোক না কেন অপরাধ করে যাওয়ার সময় কোনো না কোনো সূত্রে আলামত রেখে যায়। এখানেও এই ঘটনা ঘটেছে। সিফাত গলায় ফাঁস দেয়নি। ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল না। আসামি আসিফ সিফাত গলায় ফাঁস দিয়েছে সে-ই প্রকাশ করেছে।’ সিফাতের বাবা আমিনুল ইসলাম খন্দকার বলেন, সিফাত ছিল তাঁর একমাত্র মেয়ে। ছোটবেলা থেকে ও খুব মেধাবী ছিল। ওর স্বপ্ন ছিল বড় চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। অথচ ওর সমস্ত স্বপ্ন শেষ করে দিল আসামিরা। আর মামলার বাদী সিফাতের চাচা মিজানুর রহমান খন্দকার বললেন, সিফাতের মতো পরিণতি যেন আর কোনো মেয়ের ক্ষেত্রে না ঘটে। সিফাত ছিল বড় ভালো মেয়ে। একটা বখাটে ছেলের পাল্লায় পড়ে তাঁর স্বপ্ন শেষ হলো। সিফাতের স্বপ্ন যাঁরা শেষ করেছে তাঁদের শাস্তি চাই। আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছি।