যেমন আছেন ব্রিটেনে বর্ণিল ইতিহাস গড়া ওসমানীনগরের সন্তান লুৎফুর
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ৩:২৪ অপরাহ্ণ
লন্ডন অফিসঃ ব্রিটেনের মাটিতে বর্ণিল এক ইতিহাস গড়া ওসমানীনগরের সন্তান লুৎফুর রহমান একাকিত্ব জীবনই বেছে নিয়েছেন। ব্রিটেনে মেয়র হওয়ার পুর্বে ও পরে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে তার সরব প্রচারনা ছিল। জানা যায়, টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র পদ হারানোর পর তিনি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছেন। ভোট জালিয়াতির অভিযোগে তাকে মেয়র পদ হারাতে হয়। মাথায় ছিল আড়াই লাখ পাউন্ড পরিশোধের বোঝা। এ সংক্রান্ত এক মামলার হাজিরা দেওয়ার দুই সপ্তাহ আগে তিনি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছেন। এর পর থেকেই নিজেকে তিনি একাকিত্বে বন্ধি রেখেছেন।
২০১০ সালের ২১ অক্টোবর লুৎফুর রহমান লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে রচিত করেন এক বর্ণিল ইতিহাস। ব্রিটেনে প্রথম বাঙ্গালী এমপি হয়ে রুশনারার আলীর পর একই বছরে আরেকটি ইতিহাস গড়েছিলেন ওসমানীনগরের এই কৃতি সন্তান । বাঙালি অধ্যুষিত কাউন্সিলে জনগনের সরাসরি ভোটে তিনি প্রথম নির্বাহী ক্ষমতা সম্পন্ন মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। এমনকি ব্রিটেনের ইতিহাসে তিনিই ছিলেন সংখ্যালঘুদের মধ্যে প্রথম নির্বাচিত মেয়র ।
জানা যায়, টাওয়ার হ্যামলেটসের জনসাধারনের কাছে লুৎফুর রহমান ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় এক মানুষ। বিভিন্ন কারনে এ এলাকায় রাজনীতিতে, সমাজসেবায় তার নাম আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল । অল্প দিনের মধ্যেই টাওয়ার হ্যামলেটসের বাসিন্দাদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন লুৎফুর। সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমানের জন্ম ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশের সিলেট জেলার ওসমানীনগর থানার সিকন্দরপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সুরুজ আলী। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে লুৎফুর রহমান ২য়। বিলেতে আসেন মাত্র ৬ বছর বয়সে ১৯৭১ সালে । প্রাথমিক শিক্ষা নেন মানর প্রাইমারি স্কুল থেকে পেশায় আইনজীবী ।এই এলাকার সর্বসাধারনের সাথে তার আত্মার সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। বিভিন্ন সময়ে বর্নবাদী আন্দোলন সহ সকল ধরনের সামাজিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রথম সারিতে। স্থানীয় লেবার রাজনীতির সাথে তার সম্পৃক্ততা ১৯৮৯ সাল থেকে। ২০০২ সালে স্পিটালফিল্ড ও বাংলাটাউন এলাকা থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলার নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৩ ও ২০০৫ সালে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের এডুকেশন এবং ইউয়ুথ সার্ভিসের লীড মেম্বারের দায়িত্ব পালণ করেন। ২০০৬ ও ২০০৭ সালে কালচারাল বিভাগের লীড মেম্বার এবং সর্ব শেষ ২০০৮ ও ২০১০ সালে কাউন্সিলের শীর্ষ নেতৃত্বের আসন কাউন্সিল লিডারের পদ অত্যান্ত দক্ষতা ও সততার সাথে পালন করেন।
কিন্তু মেয়র হওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অভিযোগ ওঠে। স্থানীয় কমিউনিটির মধ্যে প্রভাব ধরে রাখতে তিনি স্থানীয় মসজিদ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মওলানা শামসুল হকের সঙ্গে বন্ধুত্বের বিষয়টি কাজে লাগান। এরপর সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে ২০১৪ সালে লুৎফুর দ্বিতীয় দফায় মেয়র নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনের আগের শুক্রবার ১০১ জন ইমাম ও মুসলিম নেতা স্থানীয় বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলোতে একটি চিঠি পাঠান, যাতে বলা হয়, লুৎফুরকে ভোট দেওয়া ‘মুসলমানদের ঈমানী দায়িত্ব’। ভোটের পর চারজন ভোটার নির্বাচন কমিশনে ভোটে প্রভাব সৃষ্টিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ করেন। রয়াল কোর্টস অফ জাস্টিস সেই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করে ২০১৫ সালের ২৪ এপ্রিল রায় দেয়। ওই রায়ে লুৎফুরের মেয়র পদ শূন্য ঘোষণা করে পুনর্নিবাচনের আদেশ দেয়। সেইসঙ্গে পাঁচ বছর লুৎফুরের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার উপর দেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞা।
স্থানীয় সংবাদপত্র দ্য ওয়ার্ফের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, লুৎফুরের আবেদনে যুক্তরাজ্যের ইনডিভিজুয়াল ইনসলভেন্সি সার্ভিস দেউলিয়া ঘোষণা করে। ২০১৪ সালে টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি, ইমামদের দিয়ে ভোটে প্রভাব বিস্তার, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষের অপপ্রচার এবং সরকারি অর্থ দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চলতি বছর ২৩ এপ্রিল আদালত লুৎফরের মেয়র পদ শূন্য ঘোষণা করে। সেইসঙ্গে চার বাদীর মামলার খরচ হিসাবে আড়াই লাখ পাউন্ড লুৎফুরকে পরিশোধের নির্দেশ দেন বিচারক। কিন্তু আড়াই মাস পরও ওই অর্থ পরিশোধ না করায় লন্ডন হাইকোর্ট গত ২০১৫ সালের জুলাই মাসে লুৎফুরের সাড়ে ৩ লাখ পাউন্ডের সম্পদ জব্দের নির্দেশ দেয়। ওই বছরের ১ ডিসেম্বর ওই মামলায় নিজের অবস্থান তুলে ধরতে আদালতে হাজির হয়েছিলেন লুৎফুর । আর আদালতে হাজির হয়ে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষনা করেছিলেন তিনি । লুৎফুরের মেয়র পদ শূন্য ঘোষণার পর গত ২০১৫ সালের ১১ জুলাই টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাচন হয়, যাতে নতুন মেয়র নির্বাচিত হন লেবার পার্টির জন বিগস।
টাওয়ার হ্যামলেটসে বাংলাদেশী কমিউনিটির অনেকেই জানান, গত কয়েক মাস ধরে লুৎফুর রহমানকে তারা জনসম্মুখে আসতে দেখেননি। তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন যারা তারও দেওলিয়া হয়ে গেছেন। কমিউনিটির অধিকাংশই মনে করেন তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। টানা দ্বিতীয়বার ভোটে জয়লাভ করার পর তার প্রতিপক্ষ সেটা মানতে পারেনি। তার বিরুদ্ধে ব্রিটেনের প্রভাবশালী কয়েকটি চ্যানেল ও প্রিন্ট মিডিয়া ডকুমেন্টারি করে। প্রথমে এগুলোর সঠিক জবাব দিলেও পরবর্তিতে দু একটির কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। কেউ কেউ মনে করেন, মেয়র থাকাকালীন বাংলাদেশী কমিউনিটির জন্য অতিরিক্ত কিছু করার চেষ্টায় তার এই পরিনতি হয়েছে। কিন্তু সময়মতো তার পাশে এখন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। এরকম একটি হতাশা থেকেই হয়তো একাকিত্ব বেছে নিয়েছেন ।