ব্রিটেনে বাংলাদেশী ইমাম হত্যায় একজনের যাবতজ্জীবন কারাদন্ড
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ
লন্ডন অফিসঃ ব্রিটেনের রচডেলে ইমাম হত্যার সাথে জড়িত একজনকে যাবতজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেছে আদালত । শুক্রবার আদালত দীর্ঘ শুনানীর পর এ রায় দেন। নিহত ইমাম জালাল উদ্দিন স্থানীয় কমিউনিটির মানুষকে তাবিজ কবজ দিয়ে রোগ নিরাময়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছিলেন। তার আচার আচরনে অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি স্থানীয় কমিউনিটিতে ব্যাপক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তবে তার তাবিজ কবজ (ব্লাক ম্যাজিক)কে পছন্দ করেনি স্থানীয় কতিপয় আইএস সমর্থক। অবশেষে তাদেরই হাতে নিহত হতে হয় তাকে।
দন্ডিত মোহাম্মেদ হোসেন সাঈদীর (২১) বিরুদ্ধে ইমামকে হত্যায় সহযোগিতার প্রমাণ মিলেছে এবং তাকে ন্যূনতম ২৪ বছর সাজা ভোগ করতে হবে বলে বিবিসি জানায়। ম্যানচেস্টার ক্রাউন কোর্টের বিচারক রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশ থেকে যাওয়া জালাল উদ্দিনের স্বজনরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন বলে এতে বলা হয়। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় গ্রেটার ম্যানচেস্টারের রচডেলের একটি পার্কে হামলার শিকার হন জালাল উদ্দিন। তার মাথা ও মুখে একাধিক জখমের চিহ্ন পাওয়া যায়, তাকে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। আদালতে বলা হয়, নামাজ আদায়ের পর মসজিদ থেকে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে দাওয়াত খেয়ে হেঁটে বাসায় ফেরার পথে ইমামের ওপর হামলা হয়। সাঈদীর সঙ্গে মোহাম্মেদ আব্দুল কাদিরকে (২৪) এ হত্যা মামলার আসামি করা হয়। হত্যাকান্ডের কয়েক দিন পর ব্রিটেন থেকে পালিয়ে তুরস্কে যান কাদির। পরে সেখান থেকে তিনি সিরিয়া যান বলে সন্দেহ তদন্তকারীদের। জালাল উদ্দিন ইসলামি পন্থায় (তাবিজের মাধ্যমে) রোগ সারানোর চেষ্টা করেন বলে গত বছর জানতে পারার পর ওই দুজন তার প্রতি ‘বিদ্বেষ’ পোষণ করতে থাকেন বলে প্রসিকিউশনের ভাষ্য।১৫ বছর আগে ব্রিটেনে যাওয়া জালাল উদ্দিন এ বছরের শেষদিকে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে স্বজনদের কাছে যেতে চেয়েছিলেন। প্রসিকিউটর পল গ্রিনি কিউসি শুনানির সময় আদালতে বলেন, ঘটনার দিন সাঈদী গাড়িতে করে কাদিরকে ওই পার্কের ফটকে নিয়ে যান। কাদির বারবার তার (ইমাম) মুখে সজোরে আঘাত করেন। তারপর তিনি পার্কের অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে সাঈদীর গাড়িতে উঠে পালিয়ে যান।
দুই কিশোরী রাত পৌনে ৯টার দিকে অচেতন অবস্থায় জালাল উদ্দিনকে দেখতে পান। এরপর দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিলে কিছুক্ষণ পর তার মৃত্যু হয়। ১৫ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে রচডেলে যাওয়া ইমাম জালাল উদ্দিন অসুস্থতা ও অশুভকে তাড়াতে তাবিজ দিয়ে ওই এলাকায় বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেন। বিচারক ডেভিড ম্যাডিসন বলেন, জালাল উদ্দিনকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই হামলা হয়েছিল বলে তিনি মনে করেন না। তবে তিনি যাতে আর তাবিজ দিতে না পারেন সেজন্য ‘তার গুরুতর ও স্থায়ীভাবে শারীরিক ক্ষতি’ করতে এই হামলা হয়। এ হত্যাকান্ডকে একজন নিরীহ মানুষের ওপর ‘পূর্বপরিকল্পিত হামলা’ হিসেবে বর্ণনা করে এতে সাঈদীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলার কথা বলেছেন তিনি।
নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে জালাল উদ্দিনের সাত ছেলের একজন সালা আল-আরিফের একটি বিবৃতি আদালতে পড়া হয়। তিনি বলেন, ১৫ বছর আগে যুক্তরাজ্যে আসার পর এবছরের শেষদিকে প্রথমবারের মতো স্ত্রী, সন্তান ও নাতি-নাতনিদের দেখতে দেশে যেতে চেয়েছিলেন তার বাবা। বাবাকে ‘একজন ধর্মপ্রাণ শান্তিকামী মানুষ, যিনি কারও প্রতি ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু দেখাননি’ তাকে কেন হত্যা করা হলো সে প্রশ্নের জবাব চান আরিফ। কোরআন সম্পর্কে জানা শোনার কারণে অনুসারীদের কাছে ‘ক্বারি সাব’ নামে পরিচিত জালাল উদ্দিনকে সাঈদী ও তার বন্ধু কাদির ‘ম্যাজিশিয়ান’ হিসেবে বিবেচনা করেন হত্যাকান্ডের ছয় মাস আগে তারা মসজিদ থেকে জালাল উদ্দিনের তাবিজ সংক্রান্ত নথিপত্র ও বই নিয়ে ধ্বংস করেন। ঘটনার পাঁচদিন পর গোয়েন্দারা সাঈদীকে তার রচডেলের বাসা থেকে গ্রেপ্তারের পর তার মোবাইলে জালাল উদ্দিনের মৃত্যুর দৃশ্য পান। এ সময় তার বাসা থেকে আইএসের প্রচারের অনেক কিছু উদ্ধার করা হয়। আদালতে উত্থাপন করা একটি ছবিতে জালালিয়া মসজিদের বাইরে আইএসের পতাকার মতো একটি পতাকা ধরে সাঈদীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আরেকটি ছবিতে তাকে দেখা যায় ‘স্ট্যাবপ্রুফ ভেস্ট’ পরা অবস্থায়। প্রসিকিউটর পল গ্রিনি আদালতে বলেন, “জালাল উদ্দিন রোগ সারাতে রুকিয়া নামে ইসলামি পন্থা চর্চা করতেন। আইএসআইএস এটাকে ’ব্ল্যাক ম্যাজিক’ হিসেবে দেখে এবং তারা মনে করে, যারা এর চর্চা করে তাদের কঠিন শাস্তি, এমনকি মৃত্যু প্রাপ্য। “বিবাদী মোহাম্মেদ হোসেন সাঈদী এবং মোহাম্মেদ আব্দুল কাদির নামে তার সহযোগী আইএসআইএসের সমর্থক এবং সে কারণে তারা ওই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন যে, যারা রুকিয়া চর্চা করে তাদের এ ধরনের শাস্তি প্রাপ্য।” কাদির আইএস সমর্থক বলে স্বীকার করলেও ইমাম হত্যায় তিনি সম্পৃক্ত নন বলে দাবি করেন সাঈদী। যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এই ছাত্র তাবিজের ব্যবহার নিয়ে নিজের আপত্তির কথাও আদালতে বলেছিলেন।