কথিত আসল বিএনপির কান্ডারি, কে এই কামরুল হাসান নাসিম?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১০:২৬ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
যশোর শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম মুক্তারপুর। গ্রামের মৃত বারিক মন্ডলের সাত ছেলের মধ্যে মুনছুর আলী মেজ। মুনছুর আলীর ৩ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় কামরুল হাসান নাসিম। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত একটি নাম। কথিত আসল বিএনপির কান্ডারি। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখল করতে গিয়ে সংবাদের শিরোনামও হয়েছে দলটি।
কে এই এম কামরুল হাসান নাসিম। সারাদেশের মতো যশোরেও তাকে নিয়ে নানা আলোচনা। মুক্তারপুর গ্রামে নাসিম সম্পর্কে পাওয়া গেছে নানা তথ্য। কামরুলের বাবা মুনছুর আলী এক সময় স্থানীয় ধুলিয়ানী সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। অল্প বেতনের চাকরি বলে তা ছেড়ে যশোর চলে যান। শুরু করেন স্ট্যাম্প ভেন্ডারের ব্যবসা। বিয়ে করেন শহরের পালবাড়ি এলাকায়। বিয়ের পর তিনি সিভিল অ্যাভিয়েশনে চাকরি নেন। পাল্টে যায় মুনছুর আলীর জীবন। চাকরির সুবাদে মুনছুর আলী ঢাকায় পাড়ি জমান। মুনছুরের ৫ ভাই এখনো বসবাস করেন মুক্তারপুর গ্রামের পৈত্রিক ভিটায়। পেশায় তারা সকলেই কৃষক। মুনছুর আলীর ছোট ভাই সিরাজুল ইসলাম চৌগাছা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডের নির্বাচিত নেতা। মুনছুর ও তার ভাইয়েরা সকলেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
১৯৯২ সালে ঢাকার একটি স্কুল থেকে এস এস সি পাশ করেন নাসিম। ১৯৯৪ সালে রাজশাহীর একটি কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও পরের বছর স্নাতোকত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। শুরু করেন ব্যবসা। সুবিধা করতে না পেরে নেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি। সে চাকরিতে বেশি দিন থাকেননি। পরে বন্ধুদের সঙ্গে মিশে নেমে পড়েন ঝুটের ব্যবসায়।
নাসিমের চাচাতো ভাই চৌগাছা জেএমএসকে কলেজের প্রভাষক মনিরুজ্জামান। তার ভাই আসল বিএনপির কর্ণধার দাবি করেছে বলতেই হাঁসিতে ফেঁটে পড়েন তিনি। কামরুলের এ দাবির কারণে পথে ঘাটে, হাটে মাঠে তারা বর্তমানে ঠাট্টার পাত্রে পরিণত হচ্ছেন বলে জানান মনিরুজ্জামান।
মনিরের বন্ধু ও চৌগাছার এবিসিডি ডিগ্রি কলেজের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রভাষক হাফিজ আল আসাদ বলেন, ও আমাদের কাছে পরিচয় দেয় উত্তরা ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা বলে। পরে শুনি সে নাকি উত্তরা ব্যাংকের মার্কেটিং সাইটের কর্মচারি ছিল। টিভির খবরে দেখলাম সে-ই নাকি আসল বিএনপির কর্ণধর। হাসি পায় ওর মুখে যখন এসব কথা শুনি।
কামরুলের চাচা সিরাজুল ইসলাম জানান, ২০০৩ সালের দিকে কামরুল প্রায়ই এলাকায় আসতেন। গ্রামে এসে তখন সে প্রচার করত আমি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা। আগামী নির্বাচনে আমি বিএনপির মনোনয়ন পাব। সে সময় ঈদ উপলক্ষে কামরুল চৌগাছার মুক্তারপুর, নারায়নপুর, পাশাপোল ও জাহাঙ্গীরপুর গ্রামে চার হাজার শাড়িও বিতরণ করে খবরের শিরোনাম হয়। এর কয়েক দিন পর চৌগাছা হাই স্কুল মাঠে কৃষকদলের ব্যানারে সমাবেশ আহ্বান করলে উপজেলা বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলের নেতৃবৃন্দ তাকে ধাওয়া দিলে কামরুল হাসান নাসিম চৌগাছা ছেড়ে পালিয়ে যান। চৌগাছায় স্থান না পেয়ে গত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর সদর আসন থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচনও করেন এই কামরুল হাসান নাসিম। নির্বাচনে তিনি ৩ শত ৪৫ ভোট পেয়ে জামানত হারান।
এরপর মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসলে বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমানের স্ত্রী ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ওবায়েদের সঙ্গে গড়েন ‘গড়বো বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন। তারপর সেখান থেকে এসে আসল বিএনপির কর্ণধার বলে দাবি করে একাধিকবার বিএনপির চেয়ারপার্সন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমানকে ব্যর্থ বলে দলের নেতৃত্ব তার কাছে ছেড়ে দেয়ার জন্য কয়েকবার আল্টিমেটাম দেন। এর পর গত বছরে দু’দুবার এবং এ বছরও দু’বার বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিস দখল নিতে যান তিনি।
কামরুল হাসান নাসিম নিজেকে দীর্ঘ দিন উপজেলা কৃষক দলের সদস্য বলে স্থানীয় ভাবে পরিচয় দিতেন। কখনো কখনো সে নিজেকে কৃষক দলের কেন্দ্রীয় নেতা বলে পরিচয় দিতেন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে চৌগাছা উপজেলা কৃষকদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মিজানুর রহমান জানান, এ নামে তার কমিটিতে কোন সদস্য কোন দিন ছিল না। প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি প্রভাষক আক্তারুজ্জামান বলেন, তারা কামরুল হাসান নাসিম কে চিনতেন না। বেশ কয়েক বছর আগে সে হঠাৎ করেই চৌগাছায় আর্বিভূত হওয়ার চেষ্টা করেন। তার কারণে দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে দেখে স্থানীয়রা তাকে ধাওয়া দিলে সে চৌগাছায় আসা যাওয়া ছেড়ে দেয়। পরে বেশ কয়েকবার যশোরে আসলেও বিএনপির নেতাকর্মীদের ভয়ে এলাকায় আসেননি।
উপজেলা বিএনপির সভাপতি জহুরুল ইসলাম জানান, প্রতিষ্ঠার পর থেকে চৌগাছা উপজেলায় কৃষকদলের মাত্র দুটি কমিটি হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠাতা কমিটি। যার সভাপতি ছিলেন মিজানুর রহমান আর সেক্রেটারি প্রভাষক আক্তারুজ্জামান। আর বর্তমান কমিটি গঠিত হয় ২০১৩ সালে। এই কমিটির সভাপতি শফিকুল ইসলাম শফি আর সেক্রেটারি পলেন রহমান। এই দুটি কমিটিতেই কামরুল ইসলাম নাসিম নামে কোন নেতার নাম নেই। আমরা যারা দীর্ঘ দিন চৌগাছায় রাজনীতি করি তারা এই নামে কাউকে চিনতাম না। হঠাৎ করেই সে ২০০৩ সালের দিকে কৃষক দলের নেতা পরিচয়ে এলাকায় আসতে শুরু করে। সে এলাকার কিছু বখাটে ছেলেকে জড়ো করে রাজনীতিতে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু চৌগাছার যুব সমাজ তার ধান্দা বুঝতে পেরে তাকে ধাওয়া দিয়ে চৌগাছা ছাড়া করে। এর পর সে আর এলাকামুখি হওয়ার সাহস দেখায়নি। এখন মাঝে মধ্যে খবরের কাগজ আর টিভির খবরে তার কথা শুনছি। সে আসল বিএনপি সাজার চেষ্টা করছে। আসলে এসবই সাজানো নাটক।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কামরুল ইসলাম নাসিমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।