বাংলাদেশকে ভালোবেসে ভেঙে পড়েছিলেন কান্নায়
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১০:০৩ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
এক সময়ের টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারিকে বোলিং কোচ হিসেবে পেল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কিন্তু অসাধারণ সব কোচকে পেয়েছে, এই পর্যন্ত বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় অবদান আছে যাঁদের। সেই সব কোচদের নিয়ে আমাদের নতুন ধারাবাহিক। দ্বিতীয় পর্বে থাকছেন এডি বারলো
গর্ডন গ্রিনিজ চলে যাওয়ার পর অল্প দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কোচ হয়ে এডি বারলো। দক্ষিণ আফ্রিকার এই ক্রিকেট কোচ তাঁর মেধার পুরোটাই ঢেলে দিয়েছিলেন টেস্ট ক্রিকেটের মহা সমুদ্রে মাত্রই পা রাখা বাংলাদেশের ভিত্তিটা গড়ে দিতে। ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে টেস্ট মর্যাদা পেতে চলা বাংলাদেশের সামগ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নের দায়িত্ব নিয়েই এ দেশে পা রেখেছিলেন বারলো।
গ্রিনিজের মতো তারকা বারলো ছিলেন না। বলা উচিত, তারকা হওয়ার সুযোগটাই তাঁর পাওয়া হয়ে ওঠেনি। ১৯৬৯ সালে বর্ণবাদের কালো থাবায় বিশ্ব ক্রিকেট থেকে যখন নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে, বারলো ছিলেন সে সময়কার অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। নিজের ক্রিকেট প্রতিভাটাকে ঠিকমতো বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার সুযোগ হয়নি তাঁর। কিন্তু তারপরও তিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব, শ্রদ্ধাভাজন এক কিংবদন্তি।
বাংলাদেশের ওয়ানডে মর্যাদা প্রাপ্তিতে অসামান্য সহযোগিতা ছিল সে সময় দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি আলী বাখারের। বাখারের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সম্পর্কও তখন দারুণ। বাখারের পরামর্শেই বারলোকে ডিরেক্টর অব কোচিং পদে নিয়োগ দেয় বিসিবি। বারলোর দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যতের কর্ম-পরিকল্পনা তৈরি করা। ১৯৯৯ সালে চালু হওয়া বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির জাতীয় ক্রিকেট লিগটা তাঁরই খসড়াপত্র মেনে মাঠে গড়িয়েছিল। পাশাপাশি জাতীয় ক্রিকেট দলের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্বও ছিল তাঁর।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের আদি ভিত্তি পুরোনো। তবে নতুন পথের যাত্রার শুরুর যে নতুন ভিত্তি গড়া হয়, সেটি বারলোরই গড়ে দেওয়া। সস্ত্রীক বাংলাদেশে এসেছিলেন বারলো। এ দেশের সবকিছুই দারুণ আপন করে নিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের চরম দুর্ভাগ্য, বারলোকে খুব বেশি দিন পাওয়া হয়ে ওঠেনি, তাঁর ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্ক পুরোপুরি ব্যবহার করা যায়নি বাংলাদেশের ক্রিকেটের কল্যাণে।
২০০০ সালের জুনে আরাধ্য টেস্ট মর্যাদাটা পেয়ে যায় বাংলাদেশ। গোটা দেশ যখন অধীন আগ্রহে অভিষেক টেস্টের দিন গুনছে, ঠিক তখনই অসুস্থ হয়ে পড়েন বারলো। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হয়ে চলাফেরার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার মুহূর্তে বারলোর অসুস্থতা ছিল বাংলাদেশের জন্য বিরাট বড় ধাক্কা।
অভিষেক টেস্টের আগে অবশ্য মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু পায়ে চলার শক্তি হারিয়ে হুইল চেয়ারে আশ্রয় নিতে হয় তাঁকে। ওই অবস্থাতেই ২০০০ সালের অক্টোবরে কেনিয়ায় অনুষ্ঠিত আইসিসি নক আউট প্রতিযোগিতায় (হালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি) দলের সঙ্গে গিয়েছিলেন তিনি। নভেম্বরের ১০ তারিখ ভারতের বিপক্ষে দেশের ঐতিহাসিক অভিষেক টেস্টেও ছিলেন তিনি দলের সঙ্গে। কিন্তু হুইল চেয়ারে বাঁধা পড়ে যাওয়া বারলো খুব বেশি দিন কাজ করে যেতে পারেননি। ২০০১ সালের শুরুর দিকে অপূর্ণতা নিয়েই চোখের জলে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি।
২০০৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর ৬৫ বছর বয়সে পরলোকে চলে যান বারলো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুভ কামনাই করে গেছেন। তাঁর স্ত্রী ক্যালি বারলো গত ফেব্রুয়ারি-মার্চের এশিয়া কাপে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ফাইনালের পর সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে আমার পরলোকগত স্বামীর সঙ্গে এসেছিলাম। ওখানে গিয়েই দেশটাকে, দেশের মানুষগুলোকে দারুণ ভালো লেগেছিল। দুর্ভাগ্য আমাদের বাংলাদেশে থাকতে দেয়নি। কিন্তু এর পর থেকে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ক্রিকেট আমাদের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিল। এবারের এশিয়া কাপে ফাইনালে খেলল বাংলাদেশ। আমার স্বামী বেঁচে থাকলে কত যে খুশি হতেন! তিনি নিশ্চয়ই স্বর্গের কোনো একটা জায়গা থেকে খেলা দেখেন আর বাংলাদেশের ক্রিকেটের বর্তমান প্রজন্মকে শুভকামনা জানান।’
যেদিন বাংলাদেশকে বিদায় বলে দেন, শিশুর মতো হু হু কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন বারলো। পেশাদার সম্পর্কের বাইরে এমনই আবেগের এক সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছিলেন মাত্র কদিনেই। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ভুলতে পারেননি। বাংলাদেশের ক্রিকেটও বারলোকে কখনোই ভুলবে না। -প্রথম আলো