সাইফুর রহমানের অভাব এখনো অনুভব করে সিলেটবাসী
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২:০০ অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
এম সাইফুর রহমান। সিলেটের উন্নয়নের স্বার্থে রাজনীতিতে আসা এক কীর্তিমান। সিলেটবাসীর আপনজন, সিলেটবন্ধু, উন্নয়ন রহমান, উন্নয়নের রূপকার, এ রকম অনেক উপাধিই ছিলো বিশ্ববরেণ্য এই অর্থনীতিবিদের। ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সিলেট প্রেমিক’ হিসেবে অভিহিত এম সাইফুর রহমান। ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি সিলেটবাসীকে ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে সেদিন বৃহত্তর সিলেটসহ সারাদেশে নেমে আসে শোকের ছায়া। কিন্তু সাত বছর পেরিয়ে গেলেও কীর্তিমান এ রাজনীতিবিদের অভাব অনুভব করছে সিলেটবাসী। চারদলীয় জোট সরকারের সময় তিনি সিলেটকে এগিয়ে নেয়ার এক নিরন্তর মিশন শুরু করেছিলেন। বলা যায়, অনেকটাই সফল হয়েছিলেন তিনি। আর এ সব কিছুর মূলে রয়েছিল গভীর দেশপ্রেম আর সিলেটবাসীর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। বিরোধী রাজনীতিবিদদের মুখেও প্রশংসা ছিল এম সাইফুর রহমানের।
পুরো সিলেট জুড়ে উন্নয়নপিয়াসী সাইফুর রহমানের স্মৃতিচিহ্ন বৃহত্তর সিলেটবাসীকে আজো ভাবায়। সুরমা নদীর তীরে কিংবা সার্কিট হাউজে। রেজিস্ট্রারি মাঠ কিংবা আলিয়া মাদরাসা ময়দান। শাহজালাল দ্বিতীয় সেতু, কুমারগাঁও সেতু কিংবা কাজির বাজার সুরমা সেতু সবখানেই তো আছেন এই উন্নয়ন রহমান।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, সিলেট শিক্ষাবোর্ডের জমি ক্রয়, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিষ্ঠা (এসএমপি), সুরমা নদীর দুই তীরের ষোলো কিলোমিটার সংরক্ষণে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ, ভিভিআইপি সার্কিট হাউজ নির্মাণ, ভিআইপি সড়ক নির্মাণ, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ক্বিনব্রিজ এবং এর আশপাশ এলাকার সৌন্দর্য বর্ধন, শিল্পকলা একাডেমি নির্মাণ, সিলেট মডেল স্কুল নির্মাণ, সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়কে অন্তত ১০টি সেতুনির্মাণ, সুনামগঞ্জে সুরমা নদীতে সেতুনির্মাণ, গোলাপগঞ্জে কুশিয়ারা ও কুড়া নদীতে দু’টি সেতুনির্মাণ, সিলেট নগরীর দুই পাশে তিনটি সেতুনির্মাণ সবই ছিল সাইফুর রহমানের দান। যদিও এর কোনোটির কাজ বিলম্বে শেষ হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে উদ্বোধন হয়েছে। কিন্তু সবাই স্বীকার করেন এসবই এম সাইফুর রহমানের দান। দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সিলেটে একমাত্র সাইফুর রহমানের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে বলে সিলেটের সুধীজনেরা বলে থাকেন।
সাবেক অর্থমন্ত্রী ও বিএনপির সাবেক স্থায়ী কমিটির সদস্য এম সাইফুর রহমান ২২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। দীর্ঘ বিরতির পর সিলেট সফর শেষে ঢাকায় ফেরার পথে ওইদিন বিকেল পৌনে ৩টায় ঢাকা-সিলেট মহসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের খাড়িয়াল এলাকায় দুর্ঘটনায় পতিত হয় সাইফুর রহমানকে বহনকারী গাড়ি।
রাস্তা থেকে গাড়িটি ছিটকে পাশের খাদের পানিতে নিমজ্জিত হয়। এসময় দ্রুত উদ্ধার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সাইফুর রহমান জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া সরকারে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সর্বোচ্চ ১২ বার বাজেট পেশ করার রেকর্ড তার দখলে। সেই সাথে বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রবর্তন করেন তিনি। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট সাইফুর রহমান ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের আহ্বানে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলে যোগ দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। মৌলভীবাজারের বাহার মর্দান গ্রামে ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণকারী এম সাইফুর রহমানের পুরো জীবন ছিল উজ্জ্বল কর্মময়। বিলেত ফেরত এ চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট নিজ যোগ্যতায় দেশের অর্থমন্ত্রী হন একাধিকবার। দেশের জাতীয় সংসদে সর্বাধিক সংখ্যক বাজেট উপস্থাপন করে হয়ে যান বিশ্ব রেকর্ডধারী।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাণিজ্যমন্ত্রী ও পরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত সরকারগুলোয় ছিলেন নির্ভরযোগ্য অর্থমন্ত্রী।
অথচ ছাত্রজীবনে তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট। তাকে সর্বপ্রথম রাজনীতিতে আনেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সাইফুর রহমান বাণিজ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তাঁকে বাণিজ্যমন্ত্রী করা হয়। জাতীয় গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন সাইফুর রহমান।
১৯৭৮ সালের জুন মাসে জিয়াউর রহমান যে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের ব্যানারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেছিলেন, সেই ফ্রন্টেরও সদস্য ছিলেন তিনি। জাগদল বিলুপ্ত করে ১৯৭৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়। সে দলেরও প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সিলেটের কৃতি সন্তাান সাইফুর রহমান। তখন কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয় তাকে। এম সাইফুর রহমান ১৯৪৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে লেটার মার্ক পেয়ে মেট্রিক, ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন এবং কারাবরণ করেন।
তিনি ১৯৫৩ সালে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য লন্ডনে যান এবং ১৯৫৮ সালে চাটার্ড অ্যাকাউটেন্স ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় বেতন কমিশনে প্রাইভেট সেক্টর হতে একমাত্র সদস্য মনোনীত হন।
১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। এম সাইফুর রহমান ১৯৬০ সালের ১৫ জুলাই বেগম দুররে সামাদ রহমান সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৭৯ সালে তিনি মৌলভীবাজার সদর আসন থেকে প্রথমমবারের মতো জাতীয় সংসদ সদস্য মনোনীত হন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে সিলেট-৪ (জৈন্তা-গোয়াইনঘাট) ও মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে, ২০০১ সালে সিলেট-১ ও মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একই সময় তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সাইফুর রহমান ১৯৯৪-৯৫ সালে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস-চেয়ারম্যান, ১৯৮০-৮২ ও ১৯৯১-৯৫ সময়কালে তিনি বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান উন্নয় ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ও ইফাড এর বাংলাদেশ গর্ভনরের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটি একনেকের চেয়ারম্যান ছিলেন।
সিলেটের বুকে সাইফুর রহমানের পদচিহ্ন আর কোনো দিন পড়বে না। কিন্তু সিলেটবাসীর হৃদয়ে আজীবন জেগে থাকবেন এ মানুষটি। ব্যক্তিগত জীবনে সাইফুর রহমান তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক ছিলেন। বড় ছেলে এম নাসের রহমান মৌলভীবাজার জেলা বিএনপি’র আহবায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য।