জঙ্গিনেতা জিয়াকে নিয়ে মৌলভীবাজারে সমালোচনার ঝড়
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২:৪৯ পূর্বাহ্ণ
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি :
মৌলভীবাজারের সন্তান মেজর সৈয়দ জিয়াউল হককে নিয়ে জেলাজুড়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি গুলশানের হলি আর্টিজম বেকারী এন্ড রেস্টুরেন্টে এবং কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় বিদেশেীসহ হতাহতের ঘটনা সংঘটিতে হওয়ার পর এই কুখ্যাত মেজর জিয়ার নাম জড়িয়ে পড়ার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর মূলত মেজর জিয়াকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা-সমালোচনার সূত্রপাত হয় জনমনে।
বিশেষ করে গত ২৭ আগস্ট শনিবার নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় নব্য জেমবির প্রধান সিলেটের বিয়ানীবাজারের কানাডা প্রবাসী তামিত চৌধুরী ২ সহযোগিসহ নিহত হওয়ার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন তামিম চ্যাপ্টার শেষ এখন জিয়ার পালা-এমন মন্তব্যের পর কুখ্যাত জিয়াকে ঘৃণার চোখে দেখছেন মৌলভীবাজারের সর্বস্থরের শান্তিপ্রিয় মানুষ।
সরেজমিন তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে প্রতিবেশী সূত্রে জানা যায়- জামায়াত ঘরানার সন্তান মেজর জিয়ার বাড়ি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের মোস্তফাপুর গ্রামে। বিতর্কিত চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হকের পৈত্রিক বাড়ি হলেও তারা সপরিবারে দীর্ঘ দিন ধরে ঢাকার বারিধারায় অবস্থান করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ জিল্লুল হক। তিনি ৭০’ এর দশকে চাকুরী নিয়ে সৌদি আরবে যান।
আলোচিত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ব্যতিত দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সৌদি আরব অবস্থান করতেন তার পিতা সৈয়দ জিল্লুল হক। তখন ছুটিতে মাঝে মধ্যে জিয়াও মা বাবা বোনদের সাথে দেখা করতে সৌদি আরবে বেড়াতে যেতেন। তিনি এক নাগাড়ে বেশী সময় সেখানে অবস্থান করতেন না।
মেজর জিয়া দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। তার ছোট এক বোন সৈয়দা জেরিনের বিয়ে হয়েছে। তার স্বামী ইমতিয়াজ চৌধুরী ঢাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত আছেন। অপর বোন সৈয়দা তারিন ঢাকার মনারাত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণিতে পড়াশুনা করেছেন। তার পিতা সৌদি আরব থেকে ১৯৯৯ সালে দেশে ফিরে ঢাকায় গার্মেন্টস ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে সে ব্যবসা গুটিয়ে ঢাকায়ই ছোটখাট ব্যবসা করেন। মেজর জিয়ার তিন চাচা রয়েছেন। তারা স্বপরিবারে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন।
মেজর জিয়ার আদি-অন্ত:
অভ্যুত্থান চেষ্টা থেকে জঙ্গিনেতা এক সময় সেনাবাহিনীর চৌকস কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। তরতর করে ওপরে ওঠার সুযোগও ছিল তার। ২০১১ সালে সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টায় পা বাড়ান তিনি। এরপর ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার খলনায়ক হিসেবে পরিচিতি পান দেশব্যাপী সবার কাছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলি বলছে- সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থাতেই জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সৈয়দ জিয়া। ২০১১ সালে কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেন তিনি। ওই বছর ১১ ডিসেম্বর এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা করা হয়।
ঊর্ধ্বতন সেনাকর্মকর্তারা তার অভ্যূত্থান চেষ্টা ভেস্তে দেন।এ ঘটনায় তাকে বহিষ্কার করা হয় সেনাবাহিনী থেকে। এরপর থেকেই আত্মগোপনে রয়েছে তিনি। আত্মগোপনে থেকেই জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান জিয়া, দায়িত্ব নেয় নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামারিক শাখার। তার পরিকল্পনায় একাধিক ব্লগার, লেখক, ভিন্ন মতালম্বী ও ধর্মাবলম্বী খুন হন।
পলাতক এই ব্যক্তির নাম মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হক। তাকে ধরিয়ে দিতে পারলে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ। ২ আগষ্ট মঙ্গলবার এই ঘোষণা দেন পুলিশের মহাপরিদর্শক এ.কে.এম শহীদুল হক।
সংশ্লিষ্টরা জানান- এই ঘটনার পর থেকেই সৈয়দ জিয়াউল হক পলাতক রয়েছেন। তাকে ধরার জন্য বিভিন্ন সময়ে অভিযানও চালানো হয়। কিন্তু আত্মগোপনে থেকে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের (এবিটি) আধ্যাত্মিক নেতা শাইখ জসিমউদ্দিন রাহমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। ধীরে ধীরে জিয়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষপর্যায়ের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। সামরিক শাখার দায়িত্ব নেন তিনি। এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম কিলিং মিশন শুরু করে।
গত বছর ঢাকার একাধিক ব্লগার ও লেখক হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে জিয়ার সরাসরি সম্পৃক্ততার কথা জানতে পারেন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন- জিয়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক শাখার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরেই সবচেয়ে বেশি ব্লগার হত্যা ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলা এত বেশি নিখুঁতভাবে করা হয়েছে যে, ঘাতকদের শনাক্ত ও গ্রেফতার কঠিন হয়ে পড়েছে।এরপর ২০১২ সালের জানুয়ারিতে সেনাসদর থেকে এই ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। সে সময় জিয়ার ছুটি ও বদলি আদেশ বাতিল করে তাকে শিগগিরই ঢাকার লগ এরিয়া সদর দপ্তরে যোগ দিতে বলা হয়। বিষয়টি টেলিফোনে ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর তাকে জানানো হলেও তিনি পলাতক থাকেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন- জিয়াউল হক ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন চৌকস অফিসার। কমান্ডো ট্রেনিং রয়েছে তার। তথ্য-প্রযুক্তিতেও দক্ষ তিনি। এ কারণে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া তরুণদের তিনি নিখুঁতভাবে প্রশিক্ষণ দিতেন। কিলিং মিশনের পরিকল্পনাও করে দিতেন তিনি।
কীভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায়, তা তার ভালোভাবেই জানা। এ কারণে গত বছরের আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ঘটানো অনেক হত্যা রহস্য উদঘাটন করতে বেগ পেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটি) সূত্রে জানা গেছে- গত ২১ জুন ব্লগার ও প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল হত্যা চেষ্টার মামলায় সুমন হোসেন পাটোয়ারী নামে এক আনসারুল্লাহ সদস্য আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ওই জবানবন্দিতে সুমন বলেন, ‘উত্তরায় আমাদের আস্তানায় এক ‘বড়ভাই’ নিয়মিত আসতেন। ওই ‘বড়ভাই’ আমাদের সবার নেতা। ‘বড়ভাই’ আমাদের বলতেন, ‘আল্লাহর জন্য কাজ করতে হবে এবং নাস্তিকদের কতল করতে হবে’। তিনি আমাদের জানান, তিনি সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন এবং জিহাদের জন্য চাকরি ছেড়ে চলে এসেছেন। আমাদের নেতা বড়ভাইয়ের নাম ইশতিয়াক বলে শুনেছি।’
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান- এই ইশতিয়াকই আসলে মেজর জিয়া। ইশতিয়াক তার সাংগঠনিক নাম। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে থাকার সময় বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করেন।
জিয়া সম্পর্কে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন- মেজর জিয়া এক সময় বারিধারা ডিওএইচএস এলাকার ৯ নম্বর সড়কের ৫১২ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় থাকতেন। তার বাবার নাম সৈয়দ জিল্লুর হক। তার সর্বশেষ ঠিকানা পলাশ, ১২তলা, মিরপুর সেনানিবাস উল্লেখ ছিল। তার পাসপোর্ট নম্বর এক্স ০৬১৪৯২৩।
ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পর পরই তিনি বারিধারার বাসা থেকে পালিয়ে যান। এরপর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ও ভাটারা এলাকায় আত্মগোপন করে ছিলেন তিনি। জিয়াকে ধরিয়ে দিলেই ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। রাজধানী গুলশান-শোলাকিয়াসহ সম্প্রতি সংঘটিত বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিহামলার মূল পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম পলাতক মেজর (বরখাস্ত) জিয়াকে ধরিয়ে দিলে বা অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিলে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে পুলিশ।
মেজর জিয়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ নেতা। মেজর জিয়ার পুরো নাম সৈয়দ মো. জিয়াউল হক। তার বাবা সৈয়দ মো. জিল্লুল হক। তাদের বাড়ি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুর গ্রামে। জিয়ার সর্বশেষ ব্যবহৃত ঠিকানা ছিল: পলাশ, ১২ তলা, মিরপুর, সেনানিবাস, ঢাকা। তার পাসপোর্ট নম্বর এক্স-০৬১৪৯২৩।