স্বাধীনতার ৪৫ বছর : রাষ্ট্রীয়ভাবে এখনো উপেক্ষিত সর্বাধিনায়ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১২:৩২ অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
কিংবদন্তীর এক মহানায়ক। উপাধিও তাঁর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। তবুও ‘উপাধি’তেই সীমাবদ্ধ বঙ্গবীরের সব অবদান। এমনকি নতুন প্রজন্মের অনেকেই তো জানেন না মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, বঙ্গবীর মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর কীর্তি।
শুধু নামকরণের মধ্যেই রাখা হয়েছে এই বীরের বীরত্ব আর কৃতিত্ব। আপোসহীন এই নেতৃত্বকে তেমনভাবে স্মরণ করে না কেউ। রাষ্ট্র, দল কিংবা জাতি কারোরই স্মরণ-সম্মানে নেই মহান এই ব্যাক্তি। তাঁর জন্ম কিংবা মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশের হাতেগোনা কিছু সংগঠন আলোচনা সভার আয়োজন করলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যান ওসমানী। জেনারেল এমএজি ওসমানীকে ‘বঙ্গবীর ওসমানী’ বলা হয়। তবে ওটা অফিসিয়াল কোনো খেতাব নয়। এটি তার বীরত্বের জন্য লোকমুখে প্রচলিত খেতাব। অথচ এই বীরের নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ। সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন আজীবন গণতন্ত্রী, ধার্মিক ও খাঁটি দেশপ্রেমিক। তার নামটি বাদ দিলে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস রচনাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমন, তেমনি স্বাধীন দেশেও জাতির দুঃসময়ে কান্ডারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন এই বঙ্গবীর। অনেক সময় তিনি জাতিকে নির্ঘাত সংঘাত থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছেন। অথচ তিনি কখনও রাষ্ট্রক্ষমতা চাননি।
গতকাল ছিলো আতাউল গণি ওসমানীর ৯৮তম জন্মবার্ষিকী। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো অনুষ্ঠান পালিত হয়নি তাঁর এই দিনে। এমনকি সিলেটের কৃতিসন্তান হিসেবে সিলেট বিভাগেও কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেনি সরকার। জেলা পরিষদ কিংবা জেলা প্রশাসন থেকেও গৃহীত হয়নি কোনো কর্মসূচি। দেশের হাতেগোনা কিছু রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবার তাঁর জন্মবার্ষিকীতে আলোচনা সভা ও দোয়ার কর্মসূচি পালন করে।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকেই অবহেলীত বাংলার ইতিহাসের মহান এই ব্যাক্তিত্ব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা জিয়াউর রহমান যেভাবে মূল্যায়িত হচ্ছেন দেশ ও জাতির কাছে, সেভাবে মূল্যায়িত হচ্ছেন না এমএজি ওসমানী। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন হয় এই দেশ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে ৪৫ বছরেও কেমন যেন ইতিহাসের দায়মুক্তি বাকী রয়ে গেছে। আর তা হলো, আমরা জেনারেল ওসমানীকে যোগ্য সম্মান করতে পারিনি। ‘জেনারেল ওসমানীকে যোগ্য স্বীকৃতি দেয়া হোক। রাষ্ট্রীয় খেতাব দেয়া হোক।’ হোক সেটা মরণোত্তর। জেনারেল ওসমানীকে রাষ্ট্রীয় খেতাব দিয়ে ইতিহাসকে দায়মুক্ত করা হোক।
অকুতোভয় এই বীরের কমান্ডে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয় দীর্ঘ নয় মাস। পাকিস্তানী হায়নাদের নির্যাতন-নিপীড়নে বিধ্বস্ত হয় পুরো বাংলা। কিন্তু মাথা নত করেননি বাংলার সাহসী এই মহান নেতা। সুসজ্জিত পাকিস্তানি সেনাদের সাথে স্বল্প অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেন। জাতিকে উপহার দেন স্বাধীন-স্বার্বভৌম মাতৃভূমি আর লাল সবুজের পতাকা।
পাক হানাদারদের সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাঠে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রে তিনি তার কর্মের ও কৃতিত্বের যথাযথ সম্মান পাননি এমন অভিযোগ তার স্বজন-অনুরক্তদের। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন হয় না রাষ্ট্রীয়ভাবে। এই আক্ষেপ থেকে এবার দাবি ওঠেছে তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের। এ দাবি করেছে জাতীয় জনতা পার্টি। গত বুধবার দলটির নেতারা সিলেটে হজরত শাহজালালের মাজার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সভায় এ দাবি জানান।
এম এ জি ওসমানী বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক কালজয়ী নাম। বাঙালি জাতির ইতিহাসের ক্ষণজন্মা এই বীর সেনানীর জন্ম ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার দয়ামীরের কৃতি সন্তান খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ও জোবেদা খাতুন তাঁর গর্বিত পিতা-মাতা। মোঃ আতাউল গণি ওসমানী ১৯৩৯ সালে বৃটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষা জীবনে তুখোড় ছাত্র হিসেবে সর্বমহলে তাঁর সুনাম ছিল। ১৯৪২ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে বৃটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর হিসেবে ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি নতুন নজির সৃষ্টি করেন। ১৯৬৭ সালে ওসমানী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্ণেল পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর থেকে তিনি সরাসরি জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ এলাকা থেকে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জেনারেল ওসমানী সেনাবাহিনীর সাবেক ও তৎকালীন সদস্যদের সংগঠিত করেন।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। দীর্ঘ ৯ মাস অসীম সাহসিকতার সাথে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে এমএজি ওসমানী পরিণত হন স্বাধীন সার্বভৌম সমর নায়কে। ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ৬৬ বছর বয়সে জেনারেল ওসমানী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।