বখাটের নির্মমতা বাঁচতে দেয়নি রিশাকে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ আগস্ট ২০১৬, ১২:৪০ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
বখাটের নির্মমতা বাঁচতে দিলো না মেয়েটিকে। অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছিলো সুরাইয়া আক্তার রিশা। কৈশোর পেরিয়ে
তারুণ্য এখনও ছুঁয়ে যায়নি যাকে। সেই কিশোরী মেয়েটিই বখাটেপনার শিকার হয়েছে। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কারণেই বখাটের ছুরিকাঘাতের শিকার হয় এই স্কুলছাত্রী। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। চারদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ার পর গতকাল সকালে হার মেনেছে রিশা। পৃথিবীর নিষ্ঠুরতাকে বিদায় জানিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছে সে। নির্মম এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ তার সহপাঠীরা। অনেকের মতোই রিশার মৃত্যুর সংবাদ মেনে নিতে পারেননি তারা। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন। বখাটের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন তারা।
‘সন্তানের লাশ কেমন করে নেব, আমি কেমন পিতা, আমার আগে আমার সন্তান কেন মরে গেল, এতো বড় ছেলে আমার ছোট মেয়েকে কিভাবে মারলো?’- এভাবেই বিলাপ করছিলেন রিশার পিতা ক্যাবল ব্যবসায়ী রমজান হোসেন। রিশার লাশ তখন ঢামেক হাসপাতালের মর্গে। বাইরে অনেক মানুষ। তার স্বজন, সহপাঠী। সবার চোখে জল। একটা নিষ্পাপ মুখ বখাটের ছুরিতে প্রাণহীন হয়ে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না তারা। রমজান হোসেন জানান, গত দুই সপ্তাহ আগে রিশাদের বাসায় ফোন করে ওবায়দুল। এসময় ডিশ লাইন সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলার বাহানা দিয়ে রমজানের মোবাইল নম্বর নেয়। এক সপ্তাহ আগে রমজানকে ফোন করে সে বলে, আমি আপনার মেয়েকে ভালোবাসি। আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। নইলে আপনার মেয়েকে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেয়। কিন্তু বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি রমজান। রিশার মা তানিয়া হোসেন বলেন, ‘দর্জির দোকানে রিশাকে নিয়ে যাওয়াটাই আমার কাল হয়েছে। আমার মেয়েকে ওই দর্জি মেরে ফেলেছে। আমি আমার মেয়েকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবো।’ মায়ের সঙ্গে দর্জির দোকানে গিয়েছিলো রিশা। সেখানেই ছিলো এক বখাটে। ওই বখাটের কুনজর পড়ে রিশার ওপর। সেই থেকেই উত্ত্যক্তের শিকার হতে থাকে রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের এই ছাত্রী। রিশার মা তানিয়া জানান, ইস্টার্ন মল্লিকার শপিং কমপ্লেক্সের বৈশাখী টেইলার্সে কর্মরত ছিল ওবায়দুল। রিশাকে বারবার প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে ওবায়দুল। প্রায় ছয় মাস আগে রিশার জন্য জামা তৈরি করতে তাকে সঙ্গে নিয়ে বৈশাখী টেইলার্সে যান তানিয়া। দোকানের রসিদে বাসার ঠিকানা ও একটি মোবাইলফোন নম্বর দেয়া ছিল। ওই মোবাইলফোনটি রিশা ও তার মা দুজনেই ব্যবহার করতেন।
টেইলার্স থেকে ফেরার পরদিন থেকে অচেনা ফোন নম্বর থেকে পরিচয় না দিয়ে কল দেয়া হতো। রিসিভ করলেই নানা ধরনের রোমান্টিক কথা বলা হতো। বিষয়টি মাকে জানায় রিশা। তানিয়া জানান, উত্ত্যক্তের পরিমাণ বাড়তেই থাকে। দিনের বিভিন্ন সময়ে কল দিতো ছেলেটি। একপর্যায়ে ফোন নম্বর পরিবর্তন করতে বাধ্য হন তারা। তবু বখাটে ওবায়দুলের হাত থেকে মুক্তি পায়নি রিশা। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে তাকে অনুসরণ করতো ওবায়দুল। প্রায়ই সিদ্দিকবাজারে রিশাদের বাসার পাশে অবস্থান করতো। তানিয়া নিজে তা দেখেছেন বলে জানান। এসময় ওবায়দুলের সঙ্গে আরো কয়েক যুবককেও ওই এলাকায় অবস্থান করতে দেখেছেন তিনি। তানিয়া জানান, ফোনে এমনকি রাস্তায় অনেকদিন রিশাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে ওবায়দুল। তারপর থেকে রিশাকে চোখে চোখে রাখতেন বলে জানান তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় রিশাকে ওবায়দুল ছুরিকাঘাত করে বলে জানান তার মা তানিয়া।
গত বুধবার দুপুরে কাকরাইল ফুটওভার ব্রিজের উপর দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে স্কুলছাত্রী রিশা গুরুতর আহত হয়। তাৎক্ষণিকভাবে আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে যান। অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত তাকে ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হয়। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিলো। সেখানেই গতকাল সকাল ৯টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে ওই কিশোরী। চিকিৎসকরা বলছেন, রিশার পেটের বাম পাশে ও বাম হাতে ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে। তার আগে এ ঘটনায় গত বুধবার রাতে রিশার মা তানিয়া হোসেন বাদী হয়ে রমনা মডেল থানায় মামলা করেন। এতে ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্সের বৈশাখী টেইলার্সের কাটিং মাস্টার ওবায়দুলকে আসামি করা হয়েছে।
রিশার মৃত্যুর সংবাদে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্র্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ক্লাস বর্জন করে স্কুলের সামনের রাস্তায় নেমে যায়। সেখানে একটি মানববন্ধন করে। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা কাকরাইল মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। রিশা নিহতের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত রাস্তায় অবস্থান নেয় তারা। এতে কাকরাইলসহ আশেপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। রিশার হত্যার বিচার দাবিসহ আজ সোমবার ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা।
পরে স্কুলের অধ্যক্ষ আবুল হোসেন ঘটনাস্থলে এসে পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও ক্লাস বন্ধের ঘোষণা দিলে শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নেয়। আন্দোলনরত রিশার সহপাঠী পিয়ালী সাহা বলেন, রিশার হত্যাকারীকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যাতে এধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। হত্যাকারী গ্রেপ্তার না হলে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দেন। রিশার সহপাঠী পিয়ালী ও আশা জানান, ক্লাস মাতিয়ে রাখতো রিশা। সে যেমন মেধাবী ছিল তেমনি চঞ্চল ও মিশুক প্রকৃতির ছিল।
পুলিশের রমনা জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার শেখ মারুফ হোসেন সর্দার বলেন, ঘটনার পর থেকে এই মামলার মূল আসামি ওবায়দুল পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ তৎপরতা চালাচ্ছে।
একইভাবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোশাররফ হোসেন বলেন, ওবায়দুলের গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁও। সে আড়াই মাস আগে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। মোবাইল ট্র্যাকিং এবং বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে তার অবস্থান শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
রিশার চাচা নিজাম উদ্দিন জানান, রিশার বাবা রমজান আলী একজন ক্যাবল ব্যবসায়ী এবং মা তানিয়া হোসেন গৃহিণী। তাদের তিন সন্তান রবি (৯) ও খুকু (৫)। এরমধ্যে রিশা (১৪) ছিল বড়।