মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আইন করেই কি প্রবাসীদের দেশহারা করবেন?
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ আগস্ট ২০১৬, ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ
পাঠক দেখে চমকে উঠছেন হয়তো। হয়তো ভাবছেন উনি আবার কি বলে? জানি না ঠিক বলছি কিনা? বিচারের ভার আপনাদের উপর। ৯০ দশকে বাংলাদেশ ছেড়েছিলাম, আশ্রয় নিয়েছিলাম লন্ডনে। বাবা এসেছিলেন ৬০ এর দশকে। বাবার কথা ছিল লন্ডনে গিয়ে লাভ নেই। বরং দেশের মাটি আকড়ে ধরে পড়ে থাক। একবার দেশ থেকে বের হয়ে গেলে আর ফিরতে পারবা না। কারন, দেশের আইন কানুন সমাজ কিছুই ভালো লাগবেনা। অবশেষে বাবার কথাই সত্যে পরিণত হলো। ১৯৯০ ইংরেজীতে লন্ডনে আসার পর ভেবেছিলাম চলে যাবো। কিন্তু যাওয়া আর হলোনা। অনেকেই চলে যায়, ঢাকা সহ দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে যারা লন্ডনে আসেন তারা পড়া লেখা শেষ করে দেশে চলে যান, কিন্তু সিলেট থেকে যারা আসেন অনেকেই আবার থেকে যান। এক সময় দেশে থেকে যারা ভিজিটে অথবা ষ্টুডেন্ট ভিসায় আসতো তাদেরকে বিয়ে করতো বৃটিশ সিটিজেন বাঙালী মেয়েরা। এখন আর সেই দিন নেই। সময় পাল্টে গেছে, এখানকার বৃটিশ বাংলাদেশী মেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক এগিয়ে গেছে। দেশ থেকে যারা লন্ডনে নতুন আসেন তাদেরকে বলা হয় ফ্রেসি। মানি তিনি ফ্রেস মিট, বাংলাদেশ থেকে নতুন এসেছেন। ঢাকা শহরে যারা বসবাস করেন তারা মফস্বলের মানুষকে বলে খ্যাত। এ রকম লন্ডনে ও ৯০ এর দশকে আমি যখন প্রথম আসি তখন ছিল ওয়ার্কম্যান, কানে লাগিয়ে গান শুনতাম, রবীন্দ্র সংগীত, দেশের গান, ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা, হায়রে দেশ, দেশের মাটির জন্য বেদনা। দেশের জন্য কান্না হতো। একদিন পূর্বলন্ডনের হোয়াইটচ্যাপেল টিউব ষ্টেশনে অপেক্ষা করছি ট্রেনের। এমন সময় বৃটিশ বাঙালী এক মেয়ে এসে দাড়ালো আমার পাশে, ভাবসাব দেখে মনে হলো তিনি পাংক, আমারও তখন যৌবনের উত্তাল দিন। জিন্সের ট্রাউজার, হাফ টি শার্ট, কেটারফিলার বুট, রেবন সানগ্লাস। মেয়েটির পড়নে ছিল টাইট জিন্স, হাফ গেঞ্জী, সুন্দর এক খানা সেন্ডেল। সামার টাইমের ড্রেস। আমি একটু হা করে তাকালাম। বাংলাদেশে যেভাবে পুরুষরা নির্লজ্জের মত হা করে থাকায়… আমার তাকানো দেখে বুঝলাম মেয়েটি আমার উপর বিরক্ত। আমার থেকে একটু দুরে গিয়ে বসলো। ট্রেন যখন আসলো তখন একই কম্পাটমেন্টে উঠে বসলাম। মেয়েটি আমার ঠিক সামনা-সামনি এসে বললো। আমি মনোযোগ দিয়ে বাংলা পত্রিকা পড়ছিলাম। হঠাত থাকিয়ে দেখি মেয়েটি অপলক দৃষ্টিতে বাংলা পত্রিকা দেখছে আমি জিজ্ঞাস করি আর ইউ বেঙ্গলী, খাতির জমানোর জন্য আমি গায়ে পড়ে কথা বললাম। মেয়েটি বললো ইয়েস আই এম। আমি একটু খুশী হয়ে বললাম মি টু , মেয়েটি বললো হোয়েইন আই কেম টু দ্য ষ্টেশন হোয়াই ইউ লোক এট মি হা–। মনে মনে বলি মেয়ে বলে কি, আমার ইজ্জতের উপর আঘাত। আমি বললাম হোয়াট ডু ইউ থিংক এবাউট ইয়োর সেল্প? ডু ইউ থিংক ইউ আর জুহি চাওলা! মেয়েটি হেসে ফেলে, তারপর কথা বার্তা এগুতে থেকে, কোথায় যাবো মেয়েটি কোথায় যাবে সব ভুলে গিয়ে আমরা গল্প গুজবে মেতে উঠি। ফাইন্যালি মেয়ে আমাকে বলে তুমি কবে এসেছো লন্ডনে? বলি ৯০ এর মে মাসে, তখন চলছিল আগষ্ট মাস ৯০। মেয়ে বলে তাহলে তো তুমি ফ্রেসি। বললাম মানে কি? মেয়ে বলে বাংলাদেশ থেকে যারা নতুন লন্ডনে আসে তাদেরকে বলা হয় ফ্রেসি। বুঝলাম মফস্বল থেকে যারা ঢাকায় যায় তাদেরকে বলা হয় খ্যাত। তো আমাকে ও বলে ফ্রেসি, মনে মনে কষ্ট ফেলাম। কি আর করা! মেয়েটি বললো আমি জুহি চাওলা না হলেও দেখতে শুনতে আপনার থেকে স্মার্ট। বললাম কথাটি আংশিক সত্য। মেয়েটি জিজ্ঞাসা করে ওয়াকম্যানে কি গান শুনেন, বললাম রবীন্দ্র সংগীত আর দেশের গান। বললো, নতুন যারা দেশ থেকে আসেন তাদের দেশের প্রতি টান থাকে, সারাক্ষন দেশের কথা ভাবেন। আসলে দেশকে তারা কিছু দিতে পারেননা। দেশও তাদেরকে কিছু দিতে পারেনা। বরং এখানে ষ্টাবলিস্ট হোন। পরে সম্ভব হলে দেশের জন্য কিছু করবেন। আলাপে আলাপে মেয়েটি বললো, দেশের কথা শুনেছি বাবার কাছ থেকে অনেক। ৭১ এ দেশেকে স্বাধীন করার জন্য বৃটেনের বাঙালীরা এখান থেকে টাকা পাঠিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। প্রবাসীদের টাকায় আর্মস কিনে যুদ্ধ করেছে বাংলাদেশ কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রবাসীরা মুল্যায়িত হননি। বাবা আজো দেশকে ভুলতে পারেননা। এখনো তিনি দেশের গরীব আতœীয় স্বজনদের লন্ডনে আনার জন্য ব্যস্ত। আমাকে বলেছেন তার গরীব বোনের ছেলেকে বিয়ে করে লন্ডনে নিয়ে আসতে। মেয়ে বললো, দেশ দেশ করে লাভ নেই। কষ্ট পাবেন, দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌছানো খুবই নিমক-হারাম। মেয়েটির কথায় আরো কষ্ট পেলাম। দেশের প্রতি আমার ঋন অনেক, বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছি দেশের আলো বাতাসে বড় হয়েছি, দেশের সাথে বেঈমানী করতে পারিনা। যতই হোক দেশ মা মাটি আমার। মেয়েটির সাথে আর কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। মেয়েটি বলেছিল একদিন দেখবেন এই দেশই আপনার আমার বিরুদ্ধে আইন করছে। সেই ১৯৯০ এর কথা।
প্রিয় পাঠক ১৯৯০ ইংরেজীর পর বুড়িগংঙ্গার পানি টেমস পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু প্রবাসীরা যে তিমিরে আছেন সে তিমিরেই রয়ে গেলেন। আমার সেই মেয়েটির কথা এখনো কানে বাজে। দেশ আইন করবে প্রবাসীদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি মন্ত্রীসভার এক বৈঠকে নাকি দ্বৈত নাগরিকদের বিরুদ্ধে একটি আইন প্রনয়নের নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, প্রবাসী কেউ বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেননা ! সেদিন প্রধানমন্ত্রীর পলিটিক্যাল এডভাইজার এইচ টি ইমাম সাহেবের সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম চ্যানেল আই ইউরোপের জন্য। তিনি বললেন, এসব আইন হলে প্রবাসীদের কোনো ক্ষতি নেই। ইমাম সাহেবকে বলেছি আমাদের টাকায় আর্মস কিনে যুদ্ধ করলেন, লন্ডন প্রবাসীদের টাকায় বাংলাদেশ ব্যংকের প্রথম রিজার্ভ হলো, এখন তাদের বিরুদ্ধে আইন করেছন ? তাহলে তাদের দেয়া টাকা,শ্রম আর ত্যাগ শোধে আসলে পরিশোধ করে দিন। উপদেষ্টা সাহেব আমার এহেন কথায় অনেকটা অবাক হয়েছেন মনে হলো। বিলেত প্রকাসীরা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকটা আশা করেছিলেন দেশ হয়ত তাদের মুল্যায়ন করবে, সংরক্ষিত আসনে এমপি বানাবে। আর প্রবাসীদের জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসন এখনো বিশ্বের বহু দেশে বহাল আছে। আর দ্বৈত নাগরিকত্বকে বরং আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করে কেবল তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল নয়,বহু উন্নত দেশও।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রবাসীরা এয়ারপোর্টে নামার পর থেকে লাঞ্চনা আর বঞ্চনা ছাড়া নিজ দেশ আর রাষ্ট্রের কাছ থেকে যোগ্য সন্মান পেয়েছেন,এমন উদাহরন নগন্য।
প্রবাসীদের ভোটাধিকারের এর ব্যাপারটি এখনো অমিমাংসিত। দেশে গেলে প্রবাসীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়, জায়গা জমি আত্বসাৎ করা হয়, বিচারের জন্য মানুশের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও বিচার মেলেনা। তারপরও প্রবাসীরা দেশকে ভুলতে পারেনা, দেশের জন্য, নাড়ীর জন্য আলাদা একটা টান অনুভব করেন তারা। সময় সুযোগ পেলেই বিমানে চড়েন তারা। এত অভিযোগের পর ও বিমান চড়েন বৃটেন প্রবাসীরা।
দেশ স্বাধীন হবার বদৌলতে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পরে মন্ত্রী হয়েছেন। ছোট কামলা বড় আমলা হয়েছেন, মেয়র চেয়ারম্যান হয়েছেন কিন্তু প্রবাসীরা কি হলেন? কি পেলেন তারা?
মাননীয় প্রধানমত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা লন্ডন প্রবাসী। শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ বৃটেনে হাউস অব পার্লামেন্টের মেম্বার হয়েছেন। যেখানে বৃটেন বাংলাদেশীদের নিয়ে আইন করবে, সেখানে নিজের দেশ বাংলাদেশ আইন করে একেবারে প্রবাসীদের দেশহারা করতে চায়। আমি বুঝি না কি লাভ তাতে? এ আইনের ফলে কার দেশে গিয়ে এমপি হওয়া বন্ধ করতে চান মহামান্য সরকার বাহাদুর। দ্বৈত নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে প্রবাসীদের দেশহারা করার আসল উদ্দেশ্য আসলে কি? অথচ দেখুন আমরা আছি। এ দেশ আমাদের সন্তানদের এমপি হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। ব্যাবসা বানিজ্য করে বৃটেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা আজ অনেকটা প্রতিষ্টিত।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ এ আইন যেন পাশ না হয়। যদি এ আইন পাশ হয় তাহলে প্রবাসীদের দুর্ভোগ আর ভোগান্তি বাড়বে। বাড়বে আমাদের প্রতি,আমাদের সন্তানদের প্রতি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বঞ্চনা। আইন করে একেবারে আমাদের প্রবাসীদের দেশহীন না করলেই কি নয়, প্রধানমন্ত্রী!
রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী সোয়েব,
সভাপতি-ইউকে-বাংলা প্রেস ক্লাব।
(এটি লেখকের নিজস্ব মতামত, সুরমানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কর্তৃপক্ষের কোন দায় নেই)