যেভাবে হত্যা করা হয় ঢাকার জঙ্গিদের
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জুলাই ২০১৬, ৬:৫৭ অপরাহ্ণ
ভোর ৫টা ৫১ মিনিট। হঠাৎ শুরু হলো- ঠা…ঠা…ঠা…! গুলির আওয়াজ! অভিযান শুরু হয়ে গেছে। ভোরের আলো তখন সবেমাত্র ফুটে উঠেছে। কান ঝালাপালা হওয়ার মতো শব্দ। থেমে থেমে গুলি। গ্রেনেড ফাটার শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। এক-দুই মিনিট নয়,এভাবে চলেছে টানা এক ঘণ্টা। আশেপাশের পুরো এলাকা থমথমে, আতঙ্ক। গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে সবার। জানালায় বা বারান্দায় এসে বোঝার চেষ্টা করছেন, বাইরের পরিস্থিতি। ৬টা ৫১ মিনিটে অভিযান সমাপ্তি ঘোষণা করে পুলিশ। গুলির শব্দ বন্ধ হয়ে আসে।
একটু পর ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মুহাম্মদ মারুফ হাসান বাইরে বেরিয়ে আসেন। সঙ্গে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। জানালেন, অভিযান সফল হয়েছে। জঙ্গিদের ধ্বংস করা গেছে। আস্তানার ভেতরেই মারা গেছে নয় জঙ্গি।
শুরুটা হয়েছিল সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে। মিরপুর থানা পুলিশ তাদের ধারাবাহিক তল্লাশি অভিযানের আওতায় কল্যাণপুর এলাকার মেসগুলোতে অভিযান চালাচ্ছিল। কল্যাণপুরের ৬ নম্বর সড়কের বেশ কয়েকটি মেসে অভিযান চালায় পুলিশ। তারপর যায় ৫ নম্বর সড়কে। সেখানকার বহুল পরিচিত ‘জাহাজ বিল্ডিং’-এ অভিযান শুরু করেন তারা।
ততক্ষণে সোমবার দিন পার হয়ে রাত সাড়ে ১২টা বেজে গেছে। পুলিশ সদস্যরা তরতর করে উঠে যান তৃতীয়তলায়। এর আগে বাড়ির সামনে বেশ কয়েকটি পুলিশের গাড়ি এসে থামে। পাঁচতলায় আস্তানা গড়ে তোলা জঙ্গিরা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দেখতে পান সবই। বুঝে যান, এবার আর তাদের রক্ষা নেই। ধরা পড়তে হবে পুলিশের হাতে।
পুলিশ তৃতীয়তলা ছেড়ে চতুর্থতলায় ওঠার চেষ্টা করতেই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন জঙ্গিরা। হ্যান্ডমেড গ্রেনেড ও গুলি ছোড়েন। এক পুলিশ সদস্যের শরীরে এসে গুলিও লাগে। কিন্তু বুলেট প্রুফ জ্যাকেট থাকায় বেঁচে যান তিনি। পাল্টা গুলি করেন পুলিশ সদস্যরাও। একই সঙ্গে পিছু হটে জঙ্গিরা। পিছু হটে আসেন পুলিশ সদস্যরাও। জঙ্গিদের দুজন পাঁচতলার গ্রিলের দরজা খুলে ঝাঁপিয়ে পড়েন নিচের দোতলার ছাদে। একজন অস্ত্র রেখে পালিয়ে যান সেখান থেকেই। আরেকজনকে আহত অবস্থায় ধরে ফেলে পুলিশ।
অভিযানে অংশ নেওয়া পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, কয়েক দিন আগে ঘটে যাওয়া গুলশানের নির্মম ঘটনা মনে করেন তারা। পজিশন নিয়ে অবস্থান করেন তৃতীয়তলায়। ওয়্যারলেস সেটে জানিয়ে দেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় অতিরিক্ত পুলিশ। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তড়িৎগতিতে প্রস্তুত হয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান পুলিশের বিশেষায়িত দল সোয়াট। মধ্যরাত থেকে শুরু হয় কর্মকৌশল ঠিক করা। ঠিক কখন অভিযান চালানো হবে, তা নিয়ে আলোচনা করেন তারা। পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ভোরের আলো ফুটবার সঙ্গে সঙ্গেই অভিযান শুরু করা হবে। অপারেশনের নাম ঠিক করেন- ‘স্টর্ম-২৬’।
পুলিশের কাউন্টার টেরিরিজমের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, অভিযান শুরু করার আগে তারা দু:শ্চিন্তায় ছিলেন হতাহতের বিষয়টি নিয়ে। জঙ্গি আস্তানার চারদিকে সাধারণ মানুষের বাস। ধারণা করতে পারছেন না, জঙ্গি আস্তানায় কত অস্ত্র ও গোলা-বারুদ মজুদ আছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত জঙ্গি সদস্য হাসানকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন কর্মকর্তারা। কিন্তু তার ওপর আস্থা রাখতে পারছিলেন না তারা। ক্রসচেকও করা যাচ্ছে না আবার জঙ্গিরা অন্য কোনও ফ্লোরের লোকজনকে জিম্মি করে ফেলে কিনা!
জঙ্গি হাসান জানিয়েছেন, আস্তানায় তারা ১১ জন ছিলেন। কিন্তু সত্যিই কি ১১ জন, নাকি চার কক্ষের বাসায় আরও জঙ্গি সদস্য রয়েছেন! এই আলোচনা চলার মধ্যেই রাত আড়াইটার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছান সোয়াট টিমের সদস্যরা। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সোয়াট সদস্যরা উপস্থিত হলে তাদের কমান্ডারকে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় বসেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
নিঘুম রাত কাটিয়ে ঘরে বসে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া। ঘটনাস্থলে দুই অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মুহাম্মদ মারুফ হোসেন ও মনিরুল ইসলাম নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন অভিযানের। তাদের সঙ্গে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান এডিসি ছানোয়ার হোসেন। কর্মকেশৗল বাস্তবায়ন করছেন তিনি। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়, ভোরের আলো ফুটবার সঙ্গে সঙ্গে অপারেশনে নামার।
পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রথম টার্গেট ছিল ব্যর্থ হওয়া যাবে না কোনোভাবেই। দ্বিতীয় টার্গেট ক্যাজুয়ালিটি যত কম হয়, ততই ভালো। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জঙ্গি আস্তানার আশেপাশের প্রতিটি ভবনের ছাদে অবস্থান নেন পুলিশ সদস্যরা। মূল অপারেশনাল দলটি ওই বাসায় গিয়ে সর্বশেষ অবস্থান নেন তৃতীয়তলায়। মঙ্গলবার ৫টা ৫১ মিনিটে সেখান থেকেই শুরু করেন অভিযান।
অভিযানে অংশ নেওয়া সোয়াটের এক সদস্য জানান, অভিযান শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই আবারও প্রতিরোধ করতে থাকেন জঙ্গিরা। একে একে ৭/৮টি হ্যান্ডগ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটান তারা। সোয়াট সদস্যরা যতই উপরের দিকে উঠছিলেন, জঙ্গিরা ততই পিছু হঠছিলেন। এক পর্যায়ে দরজা বন্ধ করে দেন তারা। অ্যাস্টল্ট রাইফেল দিয়ে সেই দরজা চুরমার করে দেন সোয়াট সদস্যরা। ভেতরে মুহুর্মূহু গুলি চলতে থাকে। সোয়াটের অভিযানের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি জঙ্গি সদস্যরা। এক পর্যায়ে সব জঙ্গিকে নিশ্চিহ্ন করে ৬টা ৫১ মিনিটে অভিযান শেষ করেন সোয়াট সদস্যরা।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, সোয়াট অভিযান শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই জঙ্গি আস্তানায় প্রবেশ করে কাউন্টার টেরিরিজমের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। তারা ঘটনাস্থল থেকে ১২টি তাজা গ্রেনেড উদ্ধার করেন। সেসব একে একে নিষ্ক্রিয় করা হয়। আলামত খুঁজে পান প্রায় ১১টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হওয়ার। ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়, ৪/৫ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য, বোমা তৈরির উপকরণ, জেল ইত্যাদি।
এছাড়া চারটি আগ্নেয়াস্ত্র, একাধিক ছোরা, চাপাতি, জিহাদি বইসহ নানারকম আলামত জব্দ করা হয়। আস্তানার ভেতর থেকে জব্দ করা হয়, অতিরিক্ত চারটি কালো পোশাক। সঙ্গে পাগড়িও ছিল। জঙ্গিদের সবার পরনেও ছিল একই কালো পোশাক।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া মঙ্গলবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন,কল্যাণপুরের অভিযানটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম সফল একটি অভিযান। সেখানে শতভাগ জঙ্গি নিশ্চিহ্ন হয়েছে এবং আমাদের পক্ষ থেকে কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।