আজ বাবা দিবসঃ অন্যরকম এক বাবা
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:২৮:২২,অপরাহ্ন ১৮ জুন ২০১৬
সুরমা ডেস্কঃ
অন্যরকম এক বাবা তিনি। খুব সাদামাটা জীবন তার। পরিশ্রমী এই বাবা সন্তানদের জন্য সারা জীবন করেছেন অক্লান্ত পরিশ্রম। কৃষিকে জীবিকা হিসেবে নিয়েইে সন্তানদের করে তুলেছেন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। পরিশ্রমী, সৎ, সাহসী এই বাবা তার জীবনের সব কাজই করেছেন সন্তানদের ঘিরে। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার গোবিন্দপুর নিবাসী এই বাবার নাম মীর শামসুল সারওয়ার। প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকেও সন্তানদের জন্য তিনি হয়েছেন আলোর দিশারি। দিয়েছেন সঠিক পথের দিশা। বয়সের ভারে এই বাবা এখন কিছুটা নুয়ে পড়লেও থামেনি তার কর্মস্পৃহা। ফজরের নামাজের পর থেকেই দিন শুরু হয় তার। মাঠে ধান লাগানো, বীজ বোনা, ফসল কাটা। সবকিছুই করেন নিজ হাতে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন কাজ করেন তিনি। তার মেজ ছেলে তৌহিদ মীর তৌহিদ বাবার কথা বলতে গিয়ে বলেন তার ছোটবেলার কথা। গ্রামের শেষ সীমানায় আমাদের বাড়ি হওয়ায় বাড়িটা ছিল অন্য সব বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন । বিদ্যুৎ না থাকায় সন্ধ্যা নামলেই সেখানে চেপে ধরতো অন্ধকার। এরই মাঝে সন্তানদের তদারকি করে হারিকেনের আলোয় পড়তে বসাতেন তাদের বাবা। সন্তানদের ভয় দূর করে সাহস জোগাতে চেয়ার পেতে বসে থাকতেন উঠানে। রাতে যখন সন্তানরা ঘুমিয়ে যেত, নিজে পাশের ঘর থেকে একটু পর পর উঠে আসতেন তাদের দেখার জন্য। কারো কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। কারও পানির পিপাসা পেয়েছে কিনা, কারো বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন কিনা। নিজেই কোলে করে সন্তানদের দিয়ে যেতেন স্কুলে। আবার নিয়ে আসতেন। পড়াশোর প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল এই বাবা সবসময় চাইতেন নিজের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় কখনও যেন ঘাটতি না হয়। নিজের জন্য কোনো কিছু না কিনলেও পূরণ করতেন ছেলেমেয়েদের সব আবদার। দুই ঈদে না দিতে পারলেও এক ঈদে সন্তানদের কিনে দিতেন জামা কাপড়। সন্তানদের হাত ধরে নিয়ে যেতেন ঈদগাহে। সন্তানদের অসুখে প্রত্যন্ত গ্রামে থেকেও করতেন সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা। এ বিষয়ে তার ছেলে আবু তৌহিদ বলেন, আমি তখন খুব ছোট। হঠাৎ করেই সন্ধ্যা বেলায় আমার জ্বর আসে। জ্বরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাইরে বাড়তে থাকে ঝড়বৃষ্টি। সেই রাতে আমার বাবাকে দেখেছি ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত সব উপেক্ষা করে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে বের হয়ে গেছেন আমার জন্য গ্রাম্য ডাক্তার আনতে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার নিয়ে ফিরে এসেছেন ভিজে চপচুপে হয়ে। সাদামাটা এই বাবার সমগ্র চিন্তাচেতনা জুড়ে রয়েছে শুধুই তার সন্তানদের মঙ্গল। এক পাঞ্জাবি বারবার সেলাই করে পড়েছেন। সব সময় থেকেছেন খালি পায়ে। কিন্তু সন্তানদের প্রয়োজনে ঠিকই কিনে দিয়েছেন নতুন পোশাক। তার ৪ সন্তান এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তারপরও পরিবর্তন হয়নি তার সাদামাটা জীবনের। ৩ ছেলে ও ১ মেয়ের জনক এই বাবার বড় মেয়ে গৃহিণী। মেজো ছেলে মীর আবু তৌহিদ ২৫তম বিসিএসে পুলিশে যোগ দিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হিসেবে কর্মরত। সেজো ছেলে সরকারি চাকুরে। ছোট ছেলে মার্চেন্ডাইজার। নিজে শত পরিশ্রম করলেও কখনও কষ্ট করতে দেননি ছেলেমেয়েদের। নিজের ফলানো ফসল, বাড়ির গাছের ফলমূল নিজেই ঝুড়িতে করে মাথায় নিয়ে চলে গেছেন বাজারে। বিক্রি করা টাকা দিয়ে সন্তানদের জন্য কিনে এসেছেন মজার খাবার। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আজীবন সন্তানদের জন্য করে গেছেন পরিশ্রম। এখনও এই বয়সে সন্তনদের জন্য ঠিক ততটাই পরিশ্রম ও কষ্ট করতে প্রস্তুত এই বাবা। তার মেজো ছেলে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদানের পর তিনি বলেছেন বেতনের টাকায় চলতে কষ্ট হলে নির্দ্বিধায় বাবাকে স্মরণ করতে। তার বাবা পরিশ্রম করে উপার্জন করে বাড়ি থেকে পাঠাবেন চাল, ডাল, সবজি, তেল, প্রয়োজনীয় সব। তবু যেন সে কখনো অন্যায় পথে পা না বাড়ায়। এই বাবার সততায় মুগ্ধ গ্রামবাসীও। গ্রামের অনেক বাসিন্দাই চোর ডাকাতের ভয়ে তার কাছে টাকা জমা রাখেন। তিনি সবার সব অর্থ পাই পাই হিসাব করে বুঝিয়ে দেন। সন্তানরা সবাই এখন এই বাবার কাছ থেকে অনেক দূরে। যে যার সংসার, কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। এরপরও বাবা প্রতিদিন তার সন্তানদের খোঁজ-খবর করেন। জানতে চান তাদের সুবিধা অসুবিধা। তারা ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করল কিনা, তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। সন্তানরা কোনোদিন খোঁজ নিতে ভুলে গেলেও বাবা ভুল করেন না কখনোই। এখনো এই বাবা তার সন্তানরা ঈদ বা অন্য কোনো উৎসবে যখন বাড়ি ফেরে তখন যত রাতই হোক না কেন, বসে থাকেন স্টেশনে গিয়ে। সন্তানদের দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরেন বুকে। প্রাণভরে করেন আশীর্বাদ।