মানুষের জীবন নিয়ে নগ্ন বাণিজ্য আর কতো!
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ নভেম্বর ২০২১, ১০:২০ অপরাহ্ণ
নাজমুল ইসলাম মকবুল:
সিলেটের রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন রোগী নিয়ে যাই ডাক্তার দেখানোর জন্য। ২৭ নভেম্বর ২০২১ শনিবার সকাল দশটার দিকে। হাসপাতালের বর্হিবিভাগে রোগী দেখানোর পর ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে বের হতেই একজন লোক এসে প্রেসক্রিপশনটা তার হাতে দেবার জন্য বললে জিজ্ঞেস করলাম কি জন্য? বললেন একটু দেখবেন এবং সেটার ছবি তুলবেন। আমি বললাম কেন? লোকটি আমতা আমতা করতে লাগলেন। বললাম আপনি কি করেন। উত্তরে বললেন স্কয়ার ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। বললাম আপনার পরিচয়পত্রটা একটু দেখান। আমি আপনার একটা ছবি তুলতে চাই। বলার সাথে সাথে পকেট থেকে মোবাইল বের করতে উদ্যত হলে লোকটি দৌড়ে পালালেন।
এরপর আরেকটি ডিপার্টমেন্টের আরেকজন ডাক্তারকে ওই রোগী দেখানোর পর বের হবার সাথে সাথে আরেকজন লোক এসে সামনে হাজির। উনিও চাইলেন আমার হাতে থাকা প্রেসক্রিপশনটা। বললাম কি করবেন। বললেন একটু দেখবো এবং একটা ছবি তুলবো। বললাম তোমার নাম কি। উত্তরে বললেন শাহিন। বাড়ী কোথায়। বললেন রংপুর। কি করেন। ঔষধ কোম্পানীতে চাকরি করি। বললাম পরিচয়পত্রটা একটু দেখান। বললেন সাথে নেই। বললাম তাহলে ভিজিটিং কার্ডটা একটু দেখান। কাচুমাচু খেয়ে বললেন স্যার সাথে নেই। শেষ হয়ে গেছে। আমি বললাম রোগীদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ের (প্রেসক্রিপশনের) ছবি তোলে বিক্রি করো। এটা কোন ধরনের ব্যবসা। কোন ধরনের চাকরি!
কথা বলতে বলতে লোকটির কয়েকটি ছবি তোললাম। দেখলাম এ ধরনের অনেক লোকই ওই হসপিটালের বাইরে ঘুর ঘুর করছে এবং রোগীরা ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হলেই প্রেসক্রিপশনটা ছো মেরে নিয়ে ছবি তোলে আবার ফেরত দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে।
আরেকজন এসে বলল ‘ক্লিনিকো ভর্তি অইতানি’। লোকটির দিকে একটু তীক্ষè নজরে চাইতেই সটকে পড়লো।
কয়েকমাস পূর্বে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিকটে একজন ডাক্তারের চেম্বারে আমার মায়ের প্রেসক্রিপশন নিয়ে গেছিলাম পরামর্শের জন্য। বের হতেই একজন লোক আমার হাতে থাকা প্রেসক্রিপশনটা নিতে চাওয়ায় আমি বললাম কিজন্য। লোকটি বললেন একটা ছবি তুলবেন। জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করতেই ওই লোকটাও সটকে পড়লেন কৌশলে।
প্রায় তিন বছর পূর্বে সিলেট ডায়াবেটিক হাসপাতাল থেকে ডাক্তার দেখানোর পর বের হতেই এমন কয়েক ডজন লোক দেখতে পাই। সবাই বলতে থাকে আমার হাতে থাকা প্রেসক্রিপশনটা তাদেরকে দেখাতে। তীক্ষè নজরে চাইতেই তারা ইতস্তত করতে লাগলেন। একজন লোক আমার পেছন পেছন কোর্ট পয়েন্ট পর্যন্ত এসে আমার হাতে থাকা প্রেসক্রিপশনটা চাইলে বললাম কিজন্য! লোকটি বললেন একটু দেখার জন্য। বললাম আমার প্রেসক্রিপশন এটাতো আমার ব্যক্তিগত জিনিস। এটা তুমি দেখার কে? এই বলে যখন ওই লোকটির ছবি তোলার জন্য মোবাইল বের করতে পকেটে হাত দিলাম তখনই লোকটি দৌড়ে পালালো।
এটা শুধু সিলেটে নয়। আমাদের বিশ^নাথেও বিভিন্ন ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে আবার অনেক ফার্মেসীতেও এ ধরনের লোক ওৎ পেতে থাকে। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হলেই বা ফার্মেসীতে ঔষধ কিনতে গেলেই প্রেসক্রিপশনটা দেখতে এবং ছবি তোলতে চায়।
কারন নির্ণয় করার জন্য বিভিন্নজনের কাছে বিষয়টি জানতে চেয়ে তাদের মতামত চাইলাম। অনেকেই বললেন বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানী কতিপয় অসাধু ডাক্তারের সাথে নাকি চুক্তি করে তাদের কোম্পানীর ঔষধ গণহারে লেখার জন্য। তাদের উৎপাদিত ঔষধ চালানোর টার্গেট দিয়ে সে অনুযায়ী নাকি অঢেল টাকা, বাসায় দামী ফার্নিচার এসি আইপিএস ফ্রিজসহ মুল্যবান সামগ্রী এমনকি ডাক্তার সাহেবের স্ত্রীর শাড়ী গয়না অলংকারসহ পছন্দের জিনিস নাকি উপহার দেয়। এছাড়া গাড়ী বাড়ী বা ফ্ল্যাটও নাকি উপহার দেয়। এসব দেবার পর তারা লোক নিয়োগ করে তাদের ঔষধ কয়টা লিখতেছেন তা মনিটর করার জন্য।
এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় ঔষধ কোম্পানীর কর্তাব্যক্তিরাও তাদের দেয়া উপঢৌকনসামগ্রী যেসব অসাধু ডাক্তারদের দেন তাদের বিশ^াস পর্যন্ত করতে পারেননা। এই অবিশ^াসের কারণেই বাহিরে বেতনধারী বা কমিশন ভিত্তিক পেয়াদা নিয়োগ দিয়ে রোগীদের প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে হয়তো নেয়া হয় পরবর্তী পদক্ষেপ। এথেকে সহজেই অনুমেয় যে আমরা কোন জগতে বসবাস করছি।
কয়দিন পূর্বে একটি টিভি চ্যানেলের খবরে দেখছিলাম দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নকল ঔষধ বিক্রির সচিত্র প্রতিবেদন। ঔষধগুলোর লেভেল এক্কেবারে আসল ঔষধের মতো। পরীক্ষা নীরিক্ষা ছাড়া আসল নকল বুঝা মুশকিল। নকল ঔষধগুলো আসল ঔষধের তুলনায় কয়েকগুণ কম দামে বিক্রয় করে ফার্মেসী মালিকদের কাছে। অসাধু ফার্র্মেসী মালিকরা এসব নকল ঔষধ কম দামে পেয়ে দারুন খুশি। বিক্রি করেন আসল ঔষধের দামে। লাভ কয়েকগুণ বেশি।
অনেক ডাক্তার রোগী দেখার পূর্বেই ভিজিটটা নিয়ে নেন। পরে রোগী দেখেন। ঔষধ দু-একটা প্রয়োজন হলেও লেখেন ১০ থেকে ১৫ টা। অনেকে প্যাড খালি রাখতে নারাজ। লিখতেই থাকেন। কারন কোম্পানীর সাথে লেনাদেনার শোধ করতে হবে। মাত্রাতিরিক্ত ঔষধ সেবনে রোগীর বারোটা বাজলেও তাদের যেন কোন মাথাব্যথা নেই। আবার অনেকে এমন লেখা উপহার দেন যা পড়া মুশকিল হয়ে পড়ে। যে যতো অপটনযোগ্য হিজিবিজি লেখা লেখতে পারেন তিনি নাকি তত বড়ো ডাক্তার।
তাবে হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান নয় ডাক্তার মহোদয়গণের মধ্যেও সকল ডাক্তার সমান নয়। আমাদের সিলেট তথা বাংলাদেশে অনেক অনেক মানবিক ডাক্তার আছেন।