প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের ৫ বছরেও শেষ হয়নি নির্মাণ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ মার্চ ২০২১, ১০:৫০ অপরাহ্ণ
২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট সফরকালে হরিপুর-জিসি-গাছবাড়ী সড়ক নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি মাত্র ৭ কিলোটিমার সড়কের কাজ। স্থানীয়রা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও কার্যত কোনো ফল মিলেনি।
৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সিলেট। ২০১৭ সালের ২২ মার্চ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এখনও সড়কের আড়াই কিলোমিটার নির্মাণ কাজ অবশিষ্ট। প্রকল্পের কাজে বিলম্বের সঠিক ব্যাখ্যাও দিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট দপ্তর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সড়কটি নির্মাণের ইতিহাস আরও দীর্ঘ। ১৯৯৮ সালে ১৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সড়কটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরে মাত্র সোয়া ৬ কিলোমিটার সড়ক ও কয়েকটি কালভার্ট-সেতু নির্মাণ হয়। সবমিলিয়ে ২৩ বছরেও সড়কটি পূর্ণতা পায়নি।
স্থানীয়রা বলছেন, ২০০১ সাল পর্যন্ত হরিপুর ও গাছবাড়ী প্রান্তে সড়কটির মাটি ভরাট কাজ হয়। ২০০৬-এর মধ্যে সড়কটির হরিপুর অংশের সাড়ে ৩ কিলোমিটার আরসিসি ঢালাই, কুশি নদীর উপর এক কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সেতু এবং গাছবাড়ী অংশে এক কিলোমিটার আরসিসি ঢালাই হয়।
এমন যখন গতি তখন গাছবাড়ী এলাকার ১৪টি গ্রামের (ঢাকনাইল রাজ) মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে অর্ধকোটি টাকা খরচ করে কানাইঘাট অংশে সড়কের মাটি ভরাট করেন। ২০১২ সালের ১৮ ফেব্রæয়ারি সড়কটির অবশিষ্ট অংশ দ্রæত বাস্তবায়নের দাবিতে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন স্থানীয়রা। গাছবাড়ী-হরিপুর সড়ক বাস্তবায়ন কমিটি এ কর্মসূচির আয়োজন করে।
২০১৫ সালে স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে তৎকালীন সংসদ সদস্য সেলিম উদ্দিনের প্রচেষ্টায় সড়কটির বাকি ৭ কিলোমিটার নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এলজিইডি। তবুও ফুরায় না সময়, শেষ হয় না কাজ। পেরিয়ে গেছে আরও পাঁচ বছর।
সরেজমিনে দেখা যায়, হরিপুর বাজার থেকে জৈন্তাপুর অংশের সাড়ে তিন কিলোমিটার সড়কে গার্ডওয়াল নেই। কিছু জায়গায় সড়ক দেবে গেছে। আশপাশে একাধিক বিল ও কৃষি জমি রয়েছে। সড়কটির নির্মাণকাজ এগিয়ে চলায় এরই মধ্যে পতিত জমি আবাদের প্রবণতা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
খোলা হাওরে কিছু বাড়িঘর গড়ে উঠেছে। চারদিকে কেবল ছোটবড় বিল-ঝিল। টিলা আর হিজল-করচের বনও আছে। সড়কটির সুবাদে বাণিজ্যিক মাছের একাধিক খামারও চোখে পড়ল।
হরিপুর থেকে সাত কিলোমিটার পরের অংশ কাঁচা। শুষ্ক মৌসুমে ছোট যান চলাচল করলেও বৃষ্টি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পাকা সড়কে উঠতেই কানাইঘাটের ঝিংগাবাড়ী ইউনিয়নের গোয়ালজুর গ্রাম।
গোয়ালজুর গ্রামে সড়কের পাশে সিলেট এমসি কলেজের বিএনসিসি’র সাবেক লিডার আমিনুল ইসলামের বাড়ি। স্কুলে লেখাপড়া অবস্থায় এই সড়ক নির্মাণকাজ দেখেছেন তিনি, এখনও সড়কে কাজ চলছে। সড়কটি চালু হলে এ অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে সিলেট শহরে যাতায়াতে সময় ও কষ্ট দুটোই লাঘব হবে বলে মনে করেন তিনি।
আমিনুল বলেন, ‘গাছবাড়ী থেকে কানাইঘাট-চতুল হয়ে সিলেট শহরে যেতে আড়াই ঘণ্টা এবং গাছবাড়ী-বোরহান উদ্দিন সড়ক হয়ে দুইঘণ্টা সময় লাগে। গাছবাড়ী-হরিপুর সড়ক চালু হলে মাত্র ৫০ মিনিটে সিলেট শহরে পৌঁছা যাবে।’
গাছবাড়ী-হরিপুর সড়কের কানাইঘাট অংশের দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৬২ কিলোমিটার। এইটুকু সড়কের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগে পাঁচবার সংসদ সদস্য পরিবর্তন হয়েছেন। সড়কটির কাজ শেষ হবে কী না তা নিয়েও সন্দিহান এলাকার বাসিন্দারা। ঝিংগাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্বাস উদ্দিন বলেন, ‘কাজ দ্রæত শেষ করতে আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে একাধিকবার তাগিদ দিয়েছি। এতদিনেও কাজ শেষ না হওয়ায় আমরা হতাশ। বৃষ্টির সময় এসেছে, চলতি অর্থবছরেও কাজ শেষ হওয়ার আশা নেই। সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক না হলে বছরের পর বছর এমন করেই যাবে।’
হাওরের ভেতর দিয়ে চলা সড়কটি আকারে ছোট হলেও মৎস আহরণ, কৃষি ও পর্যটনের সম্ভাবনা জাগাতে পারে বলে মনে করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. আশরাফ হোসাইন। তিনি বলেন, ‘সড়কটি চালু হলে অনেক সম্ভাবনা তৈরি হবে। হাওরে মৎস চাষ ও আহরণ, কৃষি ও পর্যটন বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ হলে গাছবাড়ীর সঙ্গে সিলেট সদরের যাতায়াতে দূরত্ব কমার পাশাপাশি জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাটসহ অন্যান্য উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে বলে তিনি মনে করেন।
সড়ক বাস্তবায়নে শুরু থেকে কাজ করছেন স্থানীয় বশির আহমদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল আমীন। তিনি বলেন, ‘১৯৯৮ সালে জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর বাজার থেকে কানাইঘাট উপজেলার গাছবাড়ী পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মাঝপথে আটকে গেছে। আমরা আন্দোলন করেছি, কাজ এগিয়েও আবার থমকে যায়।’ অবহেলিত এই অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগের উন্নয়নে সবার আন্তরিকতা প্রত্যাশা করেন তিনি।
গাছবাড়ী-হরিপুর সড়ক বাস্তবায়নের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সাবেক চেয়ারম্যান ফজলে হক বলেন, ‘সরকার সারাদেশে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মাত্র দু-চার বছরে এসব প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নও হচ্ছে। কিন্তু, যে সড়কের ভিত্তিপ্রস্তর প্রধানমন্ত্রী নিজে স্থাপন করেছেন পাঁচ বছরেও ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।’
বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে সেকেন্ড রুরাল ট্রান্সপোর্ট ইমপ্রæভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় ‘হরিপুর (জিসি) গাছবাড়ী সড়কের কানাইঘাট অংশের উন্নয়ন’ শীর্ষক এ কাজের ব্যয় ধরা হয় ৭ কোটি ৭৭ লাখ ৮ হাজার ২১৮ টাকা। ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি কাজ শুরু হয়ে ২০১৭ সালের ২২ মার্চ প্রকল্প মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা।
এলজিইডি সিলেট অফিস সূত্রে জানা গেছে, অসমাপ্ত সড়কের কাজ করছেন বেলাল আহমদ নামের একজন ঠিকাদার। এ বিষয়ে ঠিকাদার বেলালের মোবাইল নাম্বারে একমাসে বহুবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও যুক্ত হওয়া যায়নি। একই অভিযোগ স্থানীয়দের। তারা বলছেন, ঠিকাদার রাস্তার কাজ রক্ষণাবেক্ষণেও আসেন না, কারো ফোনও তিনি রিসিভ করেন না।
সড়ক বাস্তবায়নের আন্দোলনে শুরু থেকে যুক্ত কানাইঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক, সিলেট জেলা বারের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরে তাগিদ দিচ্ছি। বিষয়টি স্থানীয় সংসদ সদস্যের নজরেও রয়েছে। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করেছে, কিন্তু ঠিকাদার সময়মতো কাজ করছে না।’
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কানাইঘাটের প্রকৌশলী মো. রিয়াজ মাহমুদ জানান, দুই টিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছিল। কুশি নদী থেকে শুরু হওয়া অংশের ৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার কাজ আগেই শেষ হয়েছে। বাকি ৩ দশমিক ৬ কিলোমিটার সড়কের কাজ এখনও চলছে।
এলজিইডি সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইনামুল কবীর বলেন, ‘সড়কের অবশিষ্ট অংশের কাজ দ্রæত এগিয়ে চলেছে। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। আগামী জুনের মধ্যেই কাজ শেষ হওয়ার কথা।’
সূত্র: সিলেট মিরর