সিলেট বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে আগুনের উৎস কী?
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ নভেম্বর ২০২০, ১১:২১ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
সিলেটে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে আগুন লাগল কীভাবে, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এনিয়ে দেখা দিয়েছে মতবিরোধও।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন পাশের একটি বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের তার ছিঁড়ে শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগে। তবে ওই বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
সিলেটের কুমারগাঁওয়ের এই বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
শর্টসার্কিট থেকে আগুন ছড়ালেও তা ঠেকাতে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না ওই কেন্দ্রে। এছাড়া সচল ছিল না উপকেন্দ্রে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) টিভি ক্যামেরাও। সিসিটিভি ক্যামেরা সচল না থাকায় আগুনের উৎস খুঁজতে বেগ পেতে হচ্ছে তদন্ত কমিটিকেও।
বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে আগুন লাগল কীভাবে
গত ১৭ নভেম্বর সকালে সিলেটের কুমারগাঁও এলাকার পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)-এর নিয়ন্ত্রণাধীন জাতীয় গ্রিড লাইনের একটি উপকেন্দ্রে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় তা নিয়ন্ত্রণে আনে।
ওই দিনের আগুনে পিজিসিবি ও পিডিবির দুটি ট্রান্সফরমার পুড়ে যায়। একই সঙ্গে সুইচ রুম, সার্কিট ব্রেকারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি পুড়ে যায়। ক্ষতির পরিমাণ ২০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই উপকেন্দ্রের বিদ্যুৎ সঞ্চালন ক্ষমতা ২২০ মেগাওয়াট। সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় এখান থেকে।
ক্ষতিগ্রস্ত সব যন্ত্রপাতি পুরোপুরি সচল না হওয়ায় এখনও লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে প্রায় সাড়ে চার লাখ গ্রাহককে।
ঘটনা তদন্তে ওই দিনই বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) তিনটি কমিটি গঠন করে।
অতিরিক্ত সচিব রহমত উল্লাহকে আহ্বায়ক করে বিদ্যুৎ বিভাগ গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
প্রধান প্রকৌশলী (ট্রান্সমিশন ২) সাইফুল হক আহ্বায়ক করে পিজিসিবি পিডিবি আরও দুটি তদন্ত কমিটিকে সময় দেয়া হয় তিন কার্যদিবস।
তবে কোনো কমিটিই প্রতিবেদন দিতে পারেনি। তিনটি তদন্ত কমিটির সদস্যরাই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
কুমারগাঁও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের পাশেই রয়েছে সরকারি-বেসরকারি পাঁচটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এগুলো হচ্ছে- পিডিবির ২২৫ ও ২০ মেগাওয়াটের আলাদা দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, দেশ এনার্জির ১০ মেগাওয়াট, এনার্জি প্রিমার ৫০ মেগাওয়াট ও ইউনাইটেড পাওয়ারের ২৮ মেগাওয়াটের পৃথক তিনটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আগুনে এই সবটিতেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়ে।
পিডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ১৭ নভেম্বর সকালে পাশের দেশ এনার্জির মালিকানাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের তার ছিড়ে পিজিসিবির উপকেন্দ্রের টান্সমিটারের উপর পড়ে। এতে শর্টসার্কিট হয়ে আগুনের সূত্রপাত হয়।
বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে আগুন লাগল কীভাবে
তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানান, রক্ষণাবেক্ষণে দুর্বলতা, দায়িত্বে অবহেলা ও ট্রান্সফরমারসহ উপকেন্দ্রের অন্যান্য যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় সঠিক মান বজায় না রাখার কারণেও আগুন এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
পিডিবির তদন্ত কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী (বিক্রয় ও বিতরণ) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন বলেন, তারা এখনও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি। তদন্ত চলছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে।
বিদ্যুৎ সরবরাহ এখনও স্বাভাবিক না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মেরামত কাজ ও কিছু যন্ত্রপাতির ক্ষয়ক্ষতির কারণে চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এ কারণে লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে গ্রাহকদের।
পিডিবি কর্মকর্তার বক্তব্যের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে দেশ এনার্জির প্রকল্প পরিচালক জাকিউল হক বলেন, ‘আমাদের উৎপাদনকেন্দ্র থেকে আগুন ছড়ায়নি। আমরা যে লাইনের মাধ্যমে পিডিবিকে বিদ্যুৎ দেই, সেই লাইনের সার্কিট আগুনে পুড়ে যায়। সেই লাইন পিজিসিবির উপকেন্দ্রের ভেতরে অবস্থিত। ফলে আগুনের সূত্রপাত সেখানেই।’
আগুনের সূত্রপাত নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্বল নিরপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই বিদ্যুৎ বিভাগের তদন্ত কমিটির সংশ্লিষ্টদের।
তারা জানান, শর্টসার্কিট থেকে যেকোনো সময়ই আগুন লাগতে পারে। এ জন্য যেকোনো বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে আগুন যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সে জন্য সার্কিট ব্রেকারসহ নানা ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে। সিলেটের উপকেন্দ্রেও এ ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। তবে সেগুলো কাজ করেনি। নিম্নমানের যন্ত্রপাতি নাকি তদারকির অভাব এ জন্য দায়ী, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান বিদ্যুৎ বিভাগের তদন্ত কর্মকর্তারা।
কুমারগাঁওয়ে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা নেই বলেও জানিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের তদন্ত কমিটির এক সদস্য। ফলে আগুনের উৎস সন্ধানে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে তাদের।
তবে পিজিসিবির নির্বাহী প্রকৌশলী জসিম উদ্দিন বলেন, ‘এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। কিন্তু কিছুদিন আগে নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা নতুন ক্যামেরা লাগানোর জন্য একটি চাহিদাপত্র পাঠিয়েছিলাম। তার আগেই দুর্ঘটনা ঘটে যায়।’
নিম্মমানের যন্ত্রপাতি ও তদারকির অভাবের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অনেক অভিযোগই আসছে। এগুলো সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তদন্তে সত্য জানা যাবে।’