মুরাদ কেনো টার্গেটে
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ অক্টোবর ২০২০, ১২:৫৭ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
সিলেটের ইউটিউব ও ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছে পরিচিত মুখ বেলাল আহমদ মুরাদ। ডিজিটাল এই মাধ্যম দুটো অল্প সময়েই তাকে এনে দিয়েছে খ্যাতি। সিলেট ও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে মুরাদ ও তার ইউটিউব চ্যানেল গ্রিনবাংলা’র খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের ‘সিলেটি’ভাষাভাষী কোটি মানুষের কাছে। কিন্তু এবারে ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন মুরাদ। সিলেট নগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে নিহত রায়হানের মৃত্যুর আলোচনায় উঠে আসছেন মুরাদও। তাকে টেনে নিয়ে এসেছে খ্যাতি এনে দেওয়া সেই গ্রিনবাংলাই। কারণ রায়হানের মৃত্যু ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া গ্রিনবাংলার একজন অভিনেতা। মুরাদের সাথে অভিনয় করেছেন বেশ কটি নাটকে। না চাইলেও তাই আকবরের সাথে চলে আসছে মুরাদের নামও।
অভিনেতা হিসেবে মুরাদের নাটকীয় উত্থানকে যারা মেনে নিতে পারছেন না তারাই মুরাদ-আকবরের সম্পর্কের সুতোকে রায়হানের মৃত্যু ঘটনার সাথে বেঁধে দিতে চাইছেন-এমনটিই ভাষ্য গ্রিনবাংলার প্রধান ব্যক্তি বেলাল আহমদ মুরাদের। কারা মুরাদকে টার্গেট করেছেন- ডিজিটাল মাধ্যমে যারা মুরাদের খ্যাতির সাথে তাল দিয়ে চলতে পারছেন না তারা নাকি তার কর্মক্ষেত্র সাব রেজিস্ট্রি অফিসের যে সকল কর্মচারীর চক্ষুশূল তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট নগরীর শেখঘাট কলাপাড়ার এক মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে বেলাল আহমদ মুরাদ। ২০০৫ সালে এসএসসি পাশের পরপরই জীবিকার তাগিদে সিলেট সাব রেজিস্ট্রার অফিসে নকলনবিশ হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। গান ও অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক থাকায় ওই সময় নগরীর দরগাহ মহল্লা এলাকায় দিশারী নামে একটি সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রে ভর্তি হন। প্রতিমাসে ১০০ টাকা ফি দিয়ে বছর দেড়েক দিশারীতে অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নেন মুরাদ। ২০০৭ সালে বৈশাখী টিভির প্রতিভা অনুসন্ধান প্রতিযোগিতা ‘পদ্মকুঁড়ি’তে অংশগ্রহণ করে সারাদেশের মধ্যে ২য় স্থান অধিকার করেন মুরাদ। এরপর থেকে নিয়মিত বিভিন্ন স্টেজ শোতে অংশগ্রহণ করতে থাকেন মুরাদ। সাব রেজিস্ট্রার অফিসে চাকরি ও স্টেজ শো মিলিয়ে ভালোই কাটছিলো তার। চাকরিতে থাকার কারণে রাজনীতিতে অংশগ্রহণেরও সুযোগ হয়নি মুরাদের। ২০১০ সালে ঢাকায় নাটক পরিচালনা বিষয়ে প্রশিক্ষণও নেন তিনি। দিশারীর সাথে জামাতের ট্যাগ লাগার পর থেকে ধীরে ধীরে দিশারী থেকে সরে আসেন মুরাদ-এমনটি বললেন তিনি।
২০১২ সালে প্রভাত পাল, বিপ্লব কুমার এষ ও মুহিবুর রহমানকে সাথে নিয়ে বেলাল আহমদ মুরাদ শুরু করেন গ্রিনবাংলা মিডিয়া প্রোডাকশন। নির্মান করেন বেশ কয়েকটি ডকুমেন্টারি। ২০১৩ সালে গ্রিনবাংলা প্রোডাকশন থেকে নির্মিত হয় মুরাদের প্রথম সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার নাটক ‘এমএলএম টু ইউ’। ২০১৬ সাল থেকে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবের জন্য নাটক নির্মাণ করতে থাকে গ্রিনবাংলা। দর্শকপ্রিয়তাও লাভ করে নাটকগুলো। মুরাদের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে সিলেটি ভাষাভাষীদের মধ্যে বাড়তে শুরু করে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আসাম রাজ্যেও তার জনপ্রিয়তা ব্যপক। সেখানে দুটো স্টেজ শো করেছেন তিনি। পাশাপাশি দেশের টিভি নাটকে বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছেন মুরাদ। অতিথি হিসেবে গেছেন শাহরিয়ার নাজিম জয়ের ‘৩০০ সেকেন্ড’ এবং বিপিএল বিষয়ক টক শো ক্রিকেট তক্কো’তেও। আগামীতে লন্ডনে স্টেজ শো করার কথা রয়েছে তার। তবে আকবরের সাথে পরিচয়ের সূত্রে তার সব অর্জনই এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
গ্রিনবাংলার সহ প্রতিষ্ঠাতা ও মুরাদের ঘনিষ্ঠজন বিপ্লব কুমার এষ তার বন্ধুদের সাথে কিনব্রিজের নিচে আড্ডা দিতেন নিয়মিত। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সেখানেই তার সাথে পরিচয় হয় কোতোয়ালি থানার এসআই আকবর হোসেন ভূইঁয়ার। আকবর বিপ্লবকে জানান, ‘তিনিও শখের অভিনেতা। অভিনয় করেছেন সিলেটের একটি আঞ্চলিক নাটকে।’ বিপ্লবের কাছে গ্রিনবাংলার নাটকে অভিনয় করার আগ্রহও প্রকাশ করেন আকবর। এরপর বিপ্লবের মাধ্যমেই মুরাদের সাথে পরিচিত হন এসআই আকবর। কয়েক মাস পর ২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর গ্রিনবাংলার হিন্দি জামাল নাটকে প্রথমবারের মতো পুলিশ চরিত্রে অভিনয় করেন এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া। মুরাদের সাথে আকবরের দেখা হতো নাটকের শ্যুটিংয়ে বা গ্রিনবাংলার কোনো প্রোগ্রামে। কিন্তু প্রত্যেকটি প্রোগ্রামই রেকর্ডেড এবং তা ফেসবুক অথবা ইউটিউবে আপলোড করা রয়েছে বলে জানান বিপ্লব এষ। ২০২০ সাল পর্যন্ত গ্রিনবাংলার ১৯৫টি নাটকের মধ্যে ৬-৭টি নাটকে অভিনয় করেছেন অভিযুক্ত এসআই আকবর। করোনাকালে ‘গেইমওভার’ নাটকে একসঙ্গে শেষবার অভিনয় করেন বেলাল আহমদ মুরাদ ও বরখাস্তকৃত বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া। সর্বশেষ সপ্তাহ তিনেক আগে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে একটি রিসোর্টে গ্রিনবাংলার পিকনিকে অংশ নেন আকবর। গ্রিনবাংলা টিমের সাথে নয়। টিম রিসোর্টে পৌছানোর ঘন্টা দুয়েক পর একাই সিলেট থেকে শ্রীমঙ্গলে যান তিনি। মুরাদের ভাষ্য এরপর আর আকবরের সাথে তার দেখা হয়নি।
১১ সেপ্টেম্বর বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশের নির্মম নির্যাতনে মারা যান নগরীর আখালিয়া নেহারীপাড়ার যুবক রায়হান আহমদ (৩৪)। এ ঘটনায় অভিযোগের আঙ্গুল সোজা ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবর হোসেন ভূঁইয়ার দিকে উঠে। ঘটনার পরদিনই গা ঢাকা দেন আকবর। তাকে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এদিকে আকবরের নাম এ ঘটনায় উঠার পর থেকে তার পুলিশ পরিচয়ের চেয়ে গ্রিনবাংলার অভিনেতা পরিচয়টাকে প্রাধান্য দিয়ে অনেকেই রায়হান হত্যার সাথে মুরাদের যোগসূত্র খুঁজতে থাকেন। ডিজিটাল মাধ্যমের এ আলোচনাকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীও উড়িয়ে দেয়নি। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা বেলাল আহমদ মুরাদকে জিজ্ঞাসাবাদও করেন। সংগ্রহ করা হয় নগরীর জিন্দাবাজার এলাকার ওয়েষ্ট ওয়ার্ল্ড শপিং মলের সিসি টিভি ফুটেজও, যেখানে রয়েছে গ্রিন বাংলার অফিস। মুরাদের দাবি কোনো অনুসন্ধানেই তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।
কথা হয় নিহত রায়হানের মায়ের সাথে। তিনি একাত্তরের কথাকে জানান, তার ছেলে রায়হানের সাথে মুরাদের কস্মিনকালেও কোনো পরিচয় ছিলো না। রায়হানের মৃত্যুর পর প্রথম মুরাদের কথা শুনেছেন তারা। এমনকি মুরাদ তাদের বাসায়ও প্রথমবার গিয়েছেন রায়হানের মৃত্যুর পর। মুরাদের মা’সহ পরিবার এসেছিলেন সমবেদনা জানাতে।
বেলাল আহমদ মুরাদের মায়ের সাথেও কথা হয় একাত্তরের কথা’র। তিনি জানান, নিহত রায়হান বা তার পরিবারের সাথে আমাদের কখনোই কোনো ধরণের পরিচয় ছিলো না। মৃত্যুর পরে আমরা তার নাম শুনেছি। আমরা তার পরিবারকে সমবেদনা জানাতে তাদের বাড়িতেও গিয়েছি।
তবে আখালিয়ার সাথে সম্পর্ক আছে মুরাদের। তার নানাবাড়ি আখালিয়ায়। নানাবাড়িতে যাওয়া আসা খুব কমই ছিলো মুরাদের। তার মামা বর্তমানে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। তার নানাও দীর্ঘদিন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন।
রায়হান হত্যার সাথে নিজের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই দাবি করে বেলাল আহমদ মুরাদ একাত্তরের কথাকে জানান, রায়হান হত্যার সাথে আকবরসহ যে বা যারা জড়িত, তাদের সবাইকে তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করার দাবি জানাচ্ছি। মুরাদ জানান, আকবর গ্রিনবাংলার কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছে এটা সত্য। তবে নাটক বা গ্রিনবাংলার প্রোগ্রাম ছাড়া তার সাথে আমার ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক নেই। রায়হান হত্যাকান্ডে তদন্ত করে যদি আমাকে দোষী পান তাহলে প্রচলিত আইনে যে শাস্তি দেওয়া হবে আমি মাথা পেতে নেব। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি আমি এ ধরণের কোনো কিছুর সাথে জড়িত নই।সুত্র-একাত্তরের কথা