গলাকাটা বিল : সিলেটে করোনা রোগীদের অভিযোগ
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ জুন ২০২০, ১২:৩৩ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরু:
সিলেটে করোনা উপসর্গ নিয়ে মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি হয়েছিলেন মৌলভীবাজারের এক মহিলা। ৬ দিন কেবিনে থেকে চিকিৎসা নিয়ে তাকে বিল পরিশোধ করতে হয়েছে এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা। একই সময়ে আইসিইউ ইউনিটে ভর্তি হয়ে এক সপ্তাহ চিকিৎসাধীন থেকে মারা যান সদর উপজেলার বাসিন্দা আরেক রোগী। তার স্বজনদের বিল গুনতে হয়েছে চার লাখ টাকা। কয়েক দিন আগে সিলেটের মেডিকেল এলাকার এক আওয়ামী লীগ নেতাও একই হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন চার দিন। তার করোনা না হলেও শ্বাসকষ্ট নিয়ে তিনি ভর্তি ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে ওই নেতার স্বজনদের পরিশোধ করতে হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ব্যয়বহুল চিকিৎসা দেখে ওই নেতা অনেকটা জোর করেই হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যান।
পরে রাগিব-রাবেয়া হাসপাতালে নেয়ার পরপরই তার মৃত্যু হয়। নর্থইষ্ট হাসপাতালের চিত্রও তাই। ছাত্রদল নেতা এনামুল হক এনামের স্ত্রীর শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ওই হাসপাতালে। ৬দিন ভর্তি ছিলেন তার স্ত্রী। এই ৬দিনে বিল আসে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। এই বিল দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। অনেক চাপাচাপির পর ৫৫ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করে স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে বিল দিয়েছিলো সেই বিলে পিপিই বাবদ বিল ধরা হয়েছিলো ৩৫ হাজার টাকা। আর এই বিল নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন এনাম।
তিনি তার নিজের ফেসবুক আইডিতে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিষয়টি তিনি সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে জানিয়েছিলেন। শুধু এনামই নয়, সিলেটে বেসরকারি হাসপাতাল করোনা রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ দিন দিন বাড়ছে। এমন অনেক ঘটনা রয়েছে সিলেটে। যে ঘটনাগুলো পূর্বের রোগী ভর্তি না করার মতো পীড়াদায়ক। এখন এ দু’টি হাসপাতাল রোগী ভর্তি করছে। কিন্তু তাদের বিল নিয়ে চিকিৎসাধীন থাকা রোগীদেরও চিন্তার অন্ত নেই। সিলেটে সরকারিভাবে করোনা চিকিৎসার একমাত্র হাসপাতাল ছিলো শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল। ১০০ শয্যার এই হাসপাতালে রোগী বেশি। আইসিইউতে জায়গা নেই। এ কারণে স্বাস্থ্য বিভাগের তরফ থেকে শহরতলীর শাহপরান এলাকার খাদিমপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শনিবার থেকে করোনা চিকিৎসা শুরু করেছে। সরকারিভাবে হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা গ্রহণে রোগীদের টাকা লাগে না।
কেবলমাত্র কিছু ওষুধ বাইরে থেকে আনাতে হয়। সেটি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন মতো নিয়ে আসতে হয় রোগীর স্বজনদের। এজন্য তাদের তেমন ব্যয় হয় না। তবে- অক্সিজেনসহ আনুসাঙ্গিক সব কিছুরই ব্যয় হাসপাতাল বহন করে। উল্টো সিলেটে সরকারিভাবে যেসব রোগী চিকিৎসা গ্রহণ শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি যান তাদের হাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছাস্বরূপ কিছু টাকাও দেয়া হয়। কিন্তু সরকারি চিকিৎসার অপ্রতুলতার কারণে বিশেষ করে মধ্যভিত্ত পরিবারের অনেক করোনা কিংবা শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগী বেসরকারি দু’টি হাসপাতালে ছুটে যান। করোনা চিকিৎসার বিল নিয়ে এ দু’টি বেসরকারি হাসপাতালের অভিজ্ঞতা রোগীদের জন্য সন্তোষজনক নয়। রোগীর স্বজনরা জানিয়েছেন- আইসিইউ সাপোর্ট ছাড়াই শুধুমাত্র ওয়ার্ড কিংবা কেবিনে আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিয়েই রোগীদের বিল গুনতে হচ্ছে ৫০ হাজার থেকে দেড় লক্ষ টাকা। আর আইসিইউ সাপোর্ট গ্রহণকারী রোগীদের বেলায় কয়েক লাখ টাকা বিল গুনতে হয়। রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেন- হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিইর বিলও পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ কারণে বিল বেশি আসছে।
তবে- এ দু’টি হাসপাতালের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন- যেসব কোভিড কিংবা নন কোভিড রোগী শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য রোগ নিয়ে ভর্তি হন তাদের বেলায় ওষুধ দেয়া হয়। ফলে ওষুধের দাম বেশি হওয়ার কারণে বিলও বেশি আসছে। এছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিয়মের বাইরে গিয়ে বিল নিচ্ছে না বলে জানান তারা। কোভিড রোগী ভর্তি হলে একই সময়ে তাকে কোভিডের পাশাপাশি অন্যান্য জটিল রোগেরও চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। অর্থ্যাৎ একজন রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করেই ছাড় দিতে হচ্ছে।
মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের গণসংযোগ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন- বিল বেশি নেয়া হচ্ছে সেটি ঠিক না। ওষুধের বিল বেশি। পাশাপাশি অক্সিজেনেরও বিল রয়েছে। এসব মিলিয়ে একটি সন্তোষজনক বিল নেয়া হচ্ছে।
নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করেনা ইউনিটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম জানান- ‘করোনা রোগীদের বিল বেশি নেয়া হচ্ছে এই অভিযোগ সত্য নয়। বরং আমরা ভর্তুকি দিচ্ছি। মানুষের এই দুর্দিনে আমরা দৌঁড়ে পালাচ্ছি না। সামনে থেকে যুদ্ধ করছি। সরকারি কিংবা বেসরকারি তরফ থেকে মানসিক সাপোর্টও পাচ্ছি না। এরপরও আমরা নিজেদের প্রচেষ্টায় চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রেখেছি। এই মুহূর্তে ব্যবসা নয়, মানবিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা কাজ করছি।’
তিনি জানান- ‘ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই, খাবার, স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ সবই করা হচ্ছে। তাদের জন্য ইন্স্যুরেন্সের চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। সুতরাং বিল বেশি নেয়া হচ্ছে যে অভিযোগ করা হচ্ছে এতে মানসিকভাবে আমরা আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছি। কোনোভাবেই সে অভিযোগ সত্য নয়।’
স্বাস্থ্য বিভাগ সিলেটের সহকারী পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান জানিয়েছেন- ‘বিষয়টি আমরা জেনেছি। এ নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। সব কিছুই আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে। যাতে কোভিড চিকিৎসা ব্যবস্থা অব্যাহত থাকে, রোগী ও তাদের স্বজনরা স্বস্তি পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হবে।’