শ্রীমঙ্গলে বেরিয়ে এলো দুই সরকারি কর্মকর্তার থলের বিড়াল!
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ মে ২০২০, ৭:২১ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে প্রকৌশল বিভাগের দুই সরকারি কর্মকর্তার জমিতে যাতায়াতের সুবিধার্থে সরকারি অর্থ ব্যয়ে ৪টি কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়ার খবর পাওয়া গেছে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলাজুড়ে জনগুরুত্বপূর্ণ অনেক রাস্তায় প্রয়োজনীয় কালভার্ট না থাকলেও প্রায় জনমানবশূন্য পাহাড়ি এলাকায় চারটি কালভার্ট নির্মাণে এই বিপুল পরিমান সরকারি অর্থ অপচয়ের আয়োজন করা হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল প্রকৌশল বিভাগের সহকারি প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান খান ও সার্ভেয়ার সঞ্জয় কুমার পন্ডিত ছাড়াও ঢাকা সেতু বিভাগের এক প্রকৌশলীর আত্মীয় ও তার বন্ধুরা এই জমি ক্রয়ে শামিল রয়েছেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, উপজেলার বালিশিরা পাহাড় ব্লক-৩ মৌজায়, ৬৩৯ ও ৬৪২ দাগে একটি জনমানবশূন্য পাহাড়ি এলাকায় শ্রীমঙ্গল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ থেকে ৪টি বক্স কালভার্ট নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাধানগর এলাকায় উল্লেখিত মৌজায় ব্যক্তি মালিকানাধিন জমির উপর একটি পায়ে হাঁটা পথে স্থানীয় ১০/১২টি পরিবার যাতায়াত করে। মূলত এই পরিবারগুলোসহ সেখানকার বেশির ভাগ পরিবারের লোকজন পাশ্ববর্তী ইস্পাহানি জেরিন চা বাগানের রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে থাকেন।
জেরিন চা বাগানের রাস্তাটির এক প্রান্তের একটি অংশ কয়েক যুগ ধরে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে আছে। সেখানে ছড়ার পানির তোড়ে রাস্তা ভেঙ্গে গভীর গর্তে পরিণত হওয়ায় সাধারণ মানুষ এ পথে চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
স্থানীয়রা দীর্ঘ দিন থেকে সড়কের এই ভাঙ্গা অংশের উপর একটি কালভার্ট নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু স্থানীয়দের দাবি করা প্রয়োজনীয় কালভার্ট না দিয়ে ব্যক্তি মালিকানা জায়গার ওপর পায়ে হাঁটা পথে ৪টি কালভার্ট নির্মাণের তোরজোড় শুরু হয়।
স্থানীয় প্রকৌশল বিভাগ থেকে ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে অপ্রয়োজনী জায়গায় এই ৪টি কালভার্ট নির্মাণের প্রকল্প নেয়ায় এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। কুলাউড়া উপজেলার ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স রুবেল মিয়া ওই কালভার্ট নির্মাণের কাজ পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে জমির মালিক পক্ষের বাধা উপেক্ষা করে ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে অপ্রয়োজনীয় এই কালভার্ট নির্মাণের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে বেড়িয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
জানা গেছে, উপজেলা সহকারি প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান খান ও একই বিভাগের সার্ভেয়ার সঞ্জয় কুমার পন্ডিত গত বছরের ১৯ মে বিএস ৩০৩ দাগে এক দলিলে ৬ শতক জায়গা কিনেন। যার দলিল নং ২১৯৪। সেখানে যৌথভাবে রিসোর্ট করার কথা রয়েছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া, ২০১৮ সালের ১১ ডিসেম্বর সেতু বিভাগের এক প্রকৌশলীর এক আত্মীয় তাছলিম মোল্লা এবং সাহিদা খান, ফাল্গুনী নূপূর ও আবুল হোসেন দীপু নামে কয়েক ব্যক্তি বিএস ৩০৮ দাগে ৪৮৫৭ নম্বর দলিলে প্রায় ২৮ শতক জায়গা ক্রয় করেন।
মূলত উল্লেখিত সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের আত্মীয়দের চলাচলের সুবিধার্থে প্রভাব খাটিয়ে অপ্রোজনীয় পায়ে হাঁটা পথটি এলজিইডি আইডিভুক্ত করে ৪টি কালভার্ট নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এতে করে সরকারি বিপুল পরিমান অর্থ অপচয় হচ্ছে।
এদিকে জায়গার মালিকপক্ষ এই ৪টি কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়ার শুরু থেকে আপত্তি জানিয়ে আসছে। এ্যারোনিয়া এসোসিয়েট প্রাইভেট লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক জুনেদ আহমেদ জানান, ১৯৫৬ সালের এসএ ও ১৯৯০ সালের বিএস রেকর্ডে উল্লেখিত দাগসহ অপরাপর অন্য দাগের ম্যাপে এই রাস্তার কোন উল্লেখ নেই।
এই জায়গার উপর একটি ইকো পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সেখানে নিজেদের অর্থায়নে কালভার্ট নির্মাণের কথা রয়েছে। কিন্তু অধিগ্রহন এবং অনাপত্তি ছাড়াই স্থানীয় প্রকৌশল বিভাগ কেন সরকারি টাকা অপচয় করে ব্যক্তি মালিকানায় ক্রয়কৃত জায়গার উপর কালভার্ট নির্মাণ করতে যাচ্ছেন তা বোধগম্য নয়।
তিনি এই কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্প বাতিলে দাবি জানিয়ে এরই মধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য, স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সংশ্লিদের লিখিত আপত্তি জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে উপজেলা সহকারি প্রকৌশলী মনিরুজ্জমান খান জায়গা কেনার কথা স্বীকার করে বলেন, স্থানীয় রফিক মাস্টারসহ কয়েক ব্যক্তি এই ৪টি কালভার্ট নির্মাণের জন্য প্রস্তাব দিতে বলেন। পরে একটি প্রস্তাবপত্র তৈরি করে প্রকৌশল বিভাগে প্রেরণ করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, বেশীরভাগ সময় সব প্রস্তাব অনুমোদন না হলেও এই ৪টি কালভার্ট নির্মাণ প্রস্তাব কীভাবে যে এত দ্রুত পাস হলো তা আমরাও বুঝতে পারিনি।
তবে রফিক মাস্টার জানান, সেতু বিভাগের প্রকৌশলী জাকির হোসেনের ভাতিজি জামাই তাছলিম মোল্লা ও আরও কয়েকজন মিলে এখানে তাদের কাছ থেকে জমি কিনেছেন।
প্রকৌশলী জাকির হোসেন এই জায়গা কেনার বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে জাকির হোসেনের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তার মোবাইল ফোনে ক্ষুদ্র বার্তা দেয়া হলেও তিনি তার কোন জবাব দেননি।
উপজেলা সার্ভেয়ার সঞ্জয় কুমার পন্ডিত একই ভাবে জমি কেনার কথা স্বীকার করে বলেন, হ্যাঁ কিনছি, পাঁচ দশ হাজার টাকা লাভ হলে বিক্রি করে দেব।
উপজেলা প্রকৌশলী সঞ্জয় মহন সরকারের কাছে কাদের সুপারিশে উল্লেখিত ৪টি কালভার্ট প্রকল্প নেয়া হয়েছে তা জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোন তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, তথ্য অধিকার আইনে সব তথ্য দেয়া যায় না।
তথ্য অধিকার আইনে তথ্য দেয়া অনুরোধ করা হলে তিনি কে সুপারিশ করছে, কার চাহিদায় হচ্ছে এগুলো গোপনীয় বিষয় বলে জানান।
প্রকৌশলী সঞ্জয় মহন বলেন, ওই ব্যক্তি পরিচয় দিতে আমরা বাধ্য নই। তবে তিনি এই ৪টি কালভার্ট প্রকল্প প্রস্তাব পাশে জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী ও ঢাকার অতিরিক্ত নির্বাহী প্রকৌশলীর অনুমোদন রয়েছে বলে জানান।
শ্রীমঙ্গলের রাধানগরে জন মানবশূন্য এলাকায় কালভার্ট নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী আজিমুদ্দিন সরদার বলেন, আমি এখানে সদ্য যোগদান করেছি। সেখানে জনস্বার্থবিরোধী কোন কাজ হচ্ছে কিনা এবং প্রকৌশল বিভাগের যে দুই কর্মকর্তা সেখানে জমি কিনেছেন এসব বিষয়ে আমার জানা নেই।